কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য উপখাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময়। দেশের মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশেরও বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করছে। দেশের মানুষ গড়ে জনপ্রতি প্রতিদিন ৬০ গ্রাম চাহিদার বিপরীতে ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম মাছ বর্তমানে গ্রহণ করছে। তৃণমূল পর্যায়ে আমিষের যোগান বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার একের পর এক মৎস্য খাতের উপর যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিচ্ছেন। যা আজ বিশ্ব পরিমণ্ডলে স্বীকৃত ও সমাদৃত। তাছাড়া বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনের ৮৫ ভাগই বাংলাদেশের। সামুদ্রিক মাছ আহরণের পাশাপাশি মিঠা পানির মাছের উপর জোর দিয়েছেন সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন উন্মুক্ত জলাশয়ে লক্ষ টন মাছ অবমুক্ত করা হয়।
কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয়, দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে রাজস্ব বাটেজের আওতায়, খাস, সরকারি- প্রাতিষ্ঠানিক জলাশয়, বর্ষাপ্লাবিত ধানক্ষেতে জেলা মৎস্য দপ্তরের উদ্যেগে ৩৪১ টি প্রাতিষ্ঠানিক ও উন্মুক্ত জলাশয়ে ৯৬ হাজার ৫৩ কেজি পোনা মাছ অবমুক্ত করা হয়েছে। সুফলভোগীর সংখ্যা হচ্ছে ২ লক্ষ ৭৬ হাজার জন।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ বদরুজ্জামান জানান, প্রাতিষ্ঠানিক জলাধার এবং উন্মুক্ত জলাশয়গুলোতে অবমুক্তকৃত পোনা মাছের প্রজাতি হলো রুই, কাতলা, মৃগেলসহ বিভিন্ন কার্প জাতীয় পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে।
জেলা মৎস্য অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, উপজেলাসহ ৮ টি উপজেলায় ৮৮.৪১৯ হেক্টর জায়গায় উন্মুক্ত ৩৪১ টি জলাশয়ে ১.৭৮৭ মেট্রিক টন অর্থাৎ ৯৬ হাজার ৫৩ কেজি পোনা অবমুক্ত করা হয়। যার বরাদ্দ ছিলো ৭ লক্ষ ৮৫ হাজার টাকা। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ৫৩ টি জলাশয়ে ১৭.৪৭০ হেক্টর জায়গায় ০.২৯ মেট্রিক টন, চকোরিয়া উপজেলায় ৫৮টি জলাশয়ে ৩২.৪২০ হেক্টর জায়গায় ০.৩৩০ মেট্রিক টন, মহেশখালী উপজেলায় ৪টি জলাশয়ে ২.৯৮০ হেক্টর জায়গায় ০.১৭০ মেট্রিক টন, টেকনাফে উপজেলায় ৫১ টি জলাশয়ে ৯.৬০৪ হেক্টর জমিতে ০.১৬৪ মেট্রিক টন, পেকুয়া উপজেলায় ৪৬ টি জলাশয়ে ৫.৩২০ হেক্টর জমিতে ০.২৫০ মেট্রিক টন, রামু ৫০ টি জলাশয়ে ৭.৮১০ হেক্টর জায়গায় ০.২৫০ মেট্রিক টন, উখিয়া উপজেলায় ২৫ টি জলাশয়ে ৭.৩৫০ হেক্টর জমিতে ০.১৫৬ মেট্রিক টন এবং কুতুবদিয়া উপজেলায় ৫৪ টি জলাশয়ে ৫.৪৬৫ হেক্টর জমিতে ০.১৮০ মেট্রিক টন পোনা মাছ অবমুক্ত করা হয়েছে। মোট ৮ টি উপজেলায় এসব মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে।
মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের তুলানায় এবার উৎপাদনে লক্ষমাত্রা ছেড়ে যাবে বলে মনে করছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা। বলেন, আমরা পরীক্ষা- নিরীক্ষা করেই উন্মুক্ত জলাশয়গুলোতে মাছ অবমুক্ত করেছি। এখনো পর্যন্ত মরে যাওয়া বা নষ্ট হয়েছে এমন কোন খবর পায়নি।
সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তারাপদ চৌহান জানান, সদরে ৫৩ টি উন্মুক্ত জলাশয়ে ০.২৯ মেট্রিক টন মাছ অবমুক্ত করা হয়েছে। ভালো একটা আবহাওয়ার মধ্যে মাছ ছাড়া হয়েছে। মৃগেল, কতাল, রুই, ঘনিয়াসহ চার প্রজাতির মাছ ছাড়া হয়েছে। ওজনে প্রতি কেজি পোনাতে ৩০-৩৫ টি মাছ হবে।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যসূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালে মৎস্য উপখাতে গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ শতাংশ। বর্তমানে প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ৬ শতাংশ। দেশের রফতানি আয়ের প্রায় ৪ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ আসে মৎস্য উপখাত থেকে। যা ২০২১ সালের হিসেব অনুযায়ী। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ৭১ হাজার টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি করে দেশে ৩ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে। প্রকৃত মৎস্যজীবী ও জেলেদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তর এরই মধ্যে ১৭ লাখের মতো মৎস্যজীবীদের নিবন্ধন সম্পন্ন করা হয়েছে এবং ১৫ লাখ জেলের মাঝে পরিচয়পত্র বিতরণ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধানী জমিতে চাষিরা বিষপ্রয়োগ করায় দেশীয় মাছের অনেক প্রজাতি আজ বিলুপ্তির পথে। “প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছ অবমুক্ত করার আগে” সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব মৎস্য অফিস থেকে দেখতে হবে। শুধু হিসেবের খাতায় সংখ্যা যোগ করলে হবেনা। পরিমাণে মাছের সংখ্যা বাড়ছে কিনা সেটাও দেখতে হবে।
প্রসঙ্গতঃ ১৯৭৩ সালে সর্বপ্রথম গণভবন থকে আনুষ্ঠানিকভাবে মাছের পোনা অবমুক্ত করে মৎস্য চাষকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেয়ার শুভ সূচনা করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
Leave a Reply