ছবি-বনের জমি বিক্রি ও দখলদার হিসেবে যাদের নাম এসেছে তারা হলেন, ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কালাম, তার দুইভাই মো: শরিফক ও মো: আরিফ, ইউপি সদস্য আব্দু শুক্কুর, সাহাব উদ্দিন, ফিরোজ এবং ওবাইদুর রহমান।
।।ওয়াহিদ রুবেল।।
২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর কক্সবাজার ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের জয়নাল আবেদীনের মেয়ে নাছরিন জাহান রোনা স্থানীয় বদিউল আলমের ছেলে মোঃ জাহাঙ্গীর আলম এবং মৃত শফিউল আলমের ছেলে আবুল কালামকে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকায় ৫৬ কড়া নন জুডিসিয়াল স্টাম্পে (স্টাম্প নং খগ ২৬৪২৭১৮) জমি বিক্রি করেছেন। বিক্রিত এ জমি তার ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়া নয়। কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের মালিকানাধীন ফুলছড়ি মৌজার বনের জমি বিক্রি করেছেন তিনি। রোনা ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য আব্দু শুক্কুরের স্ত্রী।
শুধু রোনা নয়, বন বিভাগের প্রায় কয়েক সহস্রাধিক একর বনভূমি দখল বিক্রি করেছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। বন কর্মকর্তাদের চোখের সামনে এসব জমি বিক্রি করা হলেও তা বন্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না বনবিভাগ। অভিযোগ উঠেছে বনের জমি বিক্রির ২৫ ভাগ যায় বন কর্তমকর্তাদের পকেটে।
জমি বিক্রয়ের কিছু নন জুডিসিয়াল স্টাম্প প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
প্রতিবেদকের হাতে আসা কাগজে দেখা যায়, ২০১৭ সালের ১৩ মার্চ কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফুলছড়ি রেঞ্জের আওতাধীন ২০ শতক বনের জমি ২ লাখ টাকায় বন্ধক রাখেন ইসলামপুরের উত্তর নাফিতখালীর মৃত আব্দুল মতলবের ছেলে ছাবের আহমদ। ২০২১ সালের ১ অক্টোবর ফুলছড়ি মৌজার ৮.৬৭ শতক জমি বিক্রি করেন (স্টাম্প নং খঘ৮৫৪৪২০৭-৮-৯) নতুন অফিস জুমনগর এলাকার সোনা আলীর ছেলে মোঃ সেলিম। ২০১৮ সালের ২৮ মার্চ জুমনগর এলাকার ছৈয়দ করিমের ছেলে শামসুল আলম ফুলছড়ি মৌজার ৬ কড়া বিক্রি করেছেন (স্টাম্প নং কন২২৬০০৪৫)। আবু তাহেরের ছেলে দেলোয়ার হোসাইন প্রকাশ মনু ফুলছড়ি মৌজার ১০ কড়া জমি ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন (স্টাম্প কঠ ৭৬৯২৬৮৯)।
ছবি-ফকিরা বাজারের উত্তর প্রান্তের কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পশ্চিম পার্শ্বে বনবিভাগের সংরক্ষিত জমিতে ওবাইদুর রহমান নির্মাণ করা বাণিজ্যিক মার্কেট।
স্থানীয়দের দেয়া তথ্য মতে, ঈদগাঁও উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও স্থানীয় চেয়ারম্যান আবুল কালাম, তার দুই ভাই বিএনপি থেকে সদ্য আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া মোঃ শরিফ (ধর্ষণ ও অস্ত্র মামলায় কারাগারে আছেন) ও নব নির্বাচিত জেলা পরিষদ সদস্য আরিফুল ইসলাম, ৬ নং ওয়ার্ড সদস্য শাহাব উদ্দিন, ভিলেজার পাড়ার মৃত বদর আমিন হেডম্যানের ছেলে ওবাইদুর রহমান এবং ফকিরা বাজারের বাসিন্দা ফিরোজ প্রকাশ দালাল ফিরোজ (তিনিও ধর্ষণ মামলায় অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন)। বন বিভাগের ফুলছড়ি রেঞ্জের সহস্রাধিক জমিই এ সিন্ডিকেটের দখলে রয়েছে। তবে নেপত্যে থেকে নিজেদের অনুসারিদের দিয়ে নন জুডিসিয়াল স্টাম্প মূলে বনের জমি দখল বিক্রি করেন তারা। অনেকে আবার পাহাড় কেটে গড়ে তুলেছেন বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন। এ যেন ওয়ারিশ সূত্র পাওয়া জমি বিক্রির মহড়া। তাদের অভিযোগ জমি বিক্রির ২৫ ভাগ টাকা যায় বন কর্মকর্তাদের পকেটে। ফলে চোখ থাকতে অন্ধের ভূমিকা পালন করছ বন কর্মকর্তারা।
তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধানে জানা যায়, ঈদগাঁও ফুলছড়ি রেঞ্জের আওতাধীন নাপিতখালী বীটের মালিকনাধীন ফকিরা বাজারের উত্তর প্রান্তের কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পশ্চিম পার্শ্বে বনবিভাগের সংরক্ষিত জমিতে ওবাইদুর রহমান নির্মাণ করেছেন বাণিজ্যিক মার্কেট। এর পেছনে রয়েছে তার ভাড়া বাসা। এর একটু উত্তর পার্শ্বে আলিশান বাড়ি নির্মাণ করে বসতি করেছেন। ভিলেজার পাড়ায় বনে জমি দখল ও পাহাড় কেটে বালু বিক্রির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। এ সিন্ডিকেট সদস্যদের অন্যতম মোঃ শরীফ, ফিরোজ, ওবায়দুল ও আরিফ ফুলছড়ি রেঞ্জের নাপিতখালী বিটের পূর্ব নাপিতখালী সুলতান নগর, দুদুমিয়ার ঘোনা, ফুটখালী, ভিলেজার পাড়াা, ঈদগাঁও থানার সামনে সড়কের পশ্চিম পার্শ্বে, থানার সামনে পাহাড় কাটা, ফকিরা বাজারের পূর্ব পার্শ্বে ভোমরিয়া ঘোনা বীট এলাকার বাম বাগান এলাকা ও তার আশেপাশে কয়েকশত বসতি গড়ে তুলেছে। যা দখল বিক্রি করেছেন এ সিন্ডিকেট সদস্যরা। এছাড়া ফকিরা বাজারের উত্তর প্রান্তে মাদার ট্রি গর্জন গাছের বাগানটি দখল করেছেন চেয়ারম্যান আবুল কালাম। বর্তমানে খন্ড খন্ড দখল বিক্রি করছেন তিনি।
এভাবে বনের জমি বিক্রি করলেও তা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না বন বিভাগ। উল্টো নিরব থেকে দখল আর বিক্রিতে মৌন সমর্থণ দিয়ে যাচ্ছেন।
ছবি- ফকিরা বাজারের উত্তর প্রান্তে মাদার ট্রি গর্জন বাগানটি দখল করেছেন চেয়ারম্যান আবুল কালাম।
ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি আবুল কালাম অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেছেন।
ইউপি সদস্য আব্দু শুক্কুর বলেন, বনভূমি দখলদার একটি গোষ্ঠী আমাকে ভিলেজারের দায়িত্ব থেকে সরানোর জন্য অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমার স্ত্রী জমি বিক্রির বিষয়টি সত্য নয়।
জমি দখল ও বিক্রির বিষয়টি স্বীকার করলেও অনৈতিক সুবিধা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে ফুলছড়ি রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা ফারুখ বাবুল বলেন, ফুলছড়ি রেঞ্জের ৫টি বিটের আওতাধীন প্রায় ৬ হাজার দখলদার রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ মামলা দায়ের করা হয়েছে। যারা যারা জমি বিক্রি করছে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, আমরা যখন কোন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করি তখন জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বাঁধার সম্মুখীন হয়।
কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আনোয়ার হোসেন সরকার বলেন, বন বিভাগের জমি দখল বিক্রির কিছু কাগজ আমার হাতেও এসেছে।
তিনি বলেন, বনের জমি বিক্রি করার কোন সুযোগ নেই। যারা বিক্রি করছে বলে অভিযোগ আসছে তারা অভিযোগ অস্বীকার করায় মামলাও করা যাচ্ছে না। একই সাথে জেলা প্রশাসনের অসহযোগিতায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।
জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোঃ আমিন আল পারভেজ বলেন, আমরা সবাই যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু কেউ তা করছি না। বনবিভাগও দায়সারা আমাদের কাছে চিঠি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন। পরবর্তী আর কোন যোগাযোগ করেন না বলে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া যায়না।
Leave a Reply