1. coxsbazarekattorbd@gmail.com : Cox's Bazar Ekattor : Cox's Bazar Ekattor
  2. coxsekttornews@gmail.com : Balal Uddin : Balal Uddin
পানি নামার সঙ্গে বেরিয়ে আসছে বন্যার ক্ষতচিহ্ন - Cox's Bazar Ekattor | দৈনিক কক্সবাজার একাত্তর
শুক্রবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৪:৫০ পূর্বাহ্ন

পানি নামার সঙ্গে বেরিয়ে আসছে বন্যার ক্ষতচিহ্ন

  • আপলোড সময় : শুক্রবার, ১১ আগস্ট, ২০২৩
  • ৪৩ জন দেখেছেন

অনলাইন ডেস্ক:

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দিকে যেতেই সামনে পড়ে লোহাগাড়া উপজেলা। এই উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে গেলে আমিরাবাদ ইউনিয়ন। এখানকার জলিলনগরপাড়াতে পা রাখতেই চোখে পড়বে উত্তর আমিরাবাদ জনকল্যাণ সড়ক। বানের তোড়ে ক্ষতবিক্ষত এ সড়কটি। কিন্তু এই ক্ষতের চেয়ে বড় ক্ষত নিয়ে কাঁদতে দেখা গেল আমিরাবাদের হাজারো মানুষকে। বন্যায় প্রাণ গেছে এই এলাকার দুই তরুণের। ইউজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুনায়েদুল ইসলাম জারিফকে হারিয়েছেন তারা। মাত্র ২২ বছর বয়সেই বিদায় দিতে হয়েছে তাঁকে। জারিফকে কবর দিয়ে আসতে না আসতেই বৃহস্পতিবার আবার লাশ পাওয়া যায় সাইফুল ইসলাম শাকিবের। এবার এসএসসি পাস করেছে সে।

আমিরাবাদ জনকল্যাণ সড়কের দক্ষিণে জারিফদের বাড়ি, আর উত্তরে শাকিবদের। দুই পরিবারের মাঝে দূরত্ব বলতে আধা কিলোমিটার। জারিফের জানাজায় যেতে পারেননি শাকিবের বাবা মো. শামসুদ্দিন। তিন দিন ধরে নিখোঁজ ছেলের লাশ পেতে ব্যাকুল ছিলেন তিনি। আশা ছিল, শাকিব কোনো না কোনো জায়গা থেকে ফিরে আসবে। কিন্তু গতকাল মিলেছে তার নিথর দেহ। শাকিবের লাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন ৩০-৪০ জন মানুষ। জটলা থেকে ৩০-৪০ ফুট দূরে একাকী বসে কাঁদছিলেন শামসুদ্দিন।

‘অ পুত, তুই কেনে ভাসি গেইয়স? আঁরারে রাখি কেনে থাইবি’ (তুই কীভাবে ভেসে গেলি? আমাদের ছেড়ে কীভাবে থাকবি)? বাবার এমন বিলাপের মধ্যেই শুরু হয় কবর দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা। বাড়ি থেকে আনুমানিক ২০০ মিটার দূরে টঙ্কাবতী খালের পাড়ে দাফন করা হয় তাকে। লাশ দাফন শেষে সবাই চলে গেলেও কবরের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে শামসুদ্দিন। তাঁর চোখেমুখে বিশাল শূন্যতা। কোথায় যাবেন, কোথায় থাকবেন– এ প্রশ্নটি এখন তাঁকে ভাবাচ্ছে। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা ভাসিয়ে দিয়ে গেছে শামসুদ্দিনসহ আমিরাবাদ গ্রামের হাজারো ঘরবাড়ি। ঘরের চালসমান পানি ওঠায় তলিয়ে গেছে সবার ঘরের আসবাব। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের লক্ষাধিক ঘরবাড়ি।

মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে শাকিব ও তার তিন বন্ধু আমিরাবাদ নাজমুলেরপাড়া এলাকায় রেললাইন ও পানিবন্দি এলাকা দেখতে যায়। ফেরার সময় ওই এলাকার শাহ আলম খান সড়কে তীব্র পানির স্রোতে শাকিব, সাইফুল, শাহেদ ও সাঈদ তলিয়ে যায়। স্থানীয়রা সাইফুল, শাহেদ ও সাঈদকে জীবিত উদ্ধার করতে পারলেও শাকিবকে উদ্ধার করতে পারেননি। গতকাল মিলেছে তার মরদেহ। সেখানে গিয়েই দেখা যায় বন্যায় লন্ডভন্ড হওয়া আমিরাবাদ ইউনিয়ন।

শুধু আমিরাবাদ ইউনিয়ন নয়; বন্যার ধ্বংসযজ্ঞ চোখে পড়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের আশপাশেও। বানের পানি গতকাল নেমে গেছে অনেকখানি। কিন্তু মহাসড়কের বাঁকে বাঁকে রয়েছে অসংখ্য গর্ত। পটিয়ার শান্তিরহাট এলাকায় আধা কিলোমিটারের মধ্যে এমন গর্ত দেখা গেছে ২০ থেকে ২২টি। সাতকানিয়ার কেরানীহাট চত্বরে এমন গর্ত আছে শতাধিক। তিন দিন ধরে পানির নিচে থাকা মহাসড়কের কার্পেটিং উঠে গেছে বিভিন্ন স্থানে।

গতকাল দুপুর ২টায় কেরানীহাট চত্বরে দেখা গেল ইট-সুরকি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে গর্ত। লোহাগাড়া ও চন্দনাইশের বিভিন্ন পয়েন্টে এমন সংস্কার দেখা গেছে দিনভর। জরুরি ভিত্তিতে গর্তগুলো মেরামত করা হচ্ছে। কিন্তু যেভাবে এটি সংস্কার করা হচ্ছে, তাতে টেকসই হবে না মহাসড়ক। সামান্য বৃষ্টিতেই এ গর্তগুলো আবার ফিরবে স্বরূপে। সাতকানিয়ার প্রত্যন্ত এলাকার সংযোগ সড়ক ক্ষতবিক্ষত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। মহাসড়ক মেরামতের দিকে কর্তৃপক্ষের নজর থাকলেও গ্রামীণ সংযোগ সড়ক কবে নাগাদ সংস্কার হবে, সে ব্যাপারে কিছু বলতে পারেননি দায়িত্বশীলরা। চন্দনাইশের দুটি পৌরসভা ও আটটি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ উপজেলার বরমা, বরকল ও হাসিমপুর এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

চন্দনাইশের ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিমরান মোহাম্মদ সায়েক সমকালকে বলেন, উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা করছি। বন্যাদুর্গত এলাকায় এখন পর্যন্ত আড়াই লাখ টাকার শুকনো খাবার ও ৪৫ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।

চন্দনাইশের ধোপাছড়ি ইউনিয়নে কোনো সড়কই অক্ষত নেই। বরমা ইউনিয়নে পানির নিচে এখনও তলিয়ে আছে শতাধিক ঘর। বরকল ইউনিয়নে এখনও পানির নিচে বাজার, স্কুল ও কলেজ। বরমা ইউনিয়নের বাসিন্দা আমেনা বেগম বলেন, বানের পানিতে চার দিন ধরে ডুবে আছে বসতঘর। দু’দিন না খেয়ে ছিলাম। পাশের একটি বাড়িতে পরিবারের পাঁচজনসহ আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু কতদিন আমাদের আশ্রয় দেবে তারা?

একই উদ্বেগ দেখা গেছে কেরানীহাটের ফল বিক্রেতা জহিরুল আলমের কণ্ঠে। তিনি বলেন, আমাদের পুরো গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ঘরের কোনো জিনিস রক্ষা করতে পারিনি। উপজেলা প্রশাসনের দেওয়া শুকনা খাবার খেয়ে বেঁচে আছি তিন দিন ধরে। এই ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে উঠব জানি না।

জহিরুল যখন কথা বলছিলেন তখন তাঁর পাশে ছিলেন রেস্টুরেন্টে চাকরি করা মোহাম্মদ আলী। ১৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ আলীর পরিবার আছে আশ্রয়কেন্দ্রে। বাড়ির পাশের একটি স্কুলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে তাদের সাত সদস্যের পরিবার। তিনি বললেন, বন্যা শুরু হওয়ার পর ঘরের সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। রেস্টুরেন্টও বন্ধ হয়ে গেছে। গত চার দিন কোনো কাজ ছিল না। ঘরে কোনো টাকাও নেই। আগামীকাল কী খাব জানা নেই। আজকে রেস্টুরেন্ট খুলেছে। কিন্তু মালিক বলেছেন ব্যবসা খারাপ। এখন টাকা দিতে পারবেন না। মোহাম্মদ আলীদের মতো অজানা উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের লক্ষাধিক পরিবারে। ত্রাণের জন্য এখন হাহাকার করছে অসহায় মানুষ।

লোহাগাড়া উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ শাহজাহান জানান, এখানকার ক্ষতিগ্রস্ত ৯টি উপজেলাতে লক্ষাধিক বাসিন্দা আছে। এখন পর্যন্ত তারা ৫০ টন চাল, এক হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার ও ৩ লাখ টাকার জিআর নগদ দিয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তুলনায় ত্রাণের পরিমাণ কম। এটি আরও বাড়াতে জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।

কক্সবাজারে ১৪০ কিলোমিটার সড়ক চুরমার

কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, প্লাবিত এলাকাগুলোর মধ্যে একটি চকরিয়া উপজেলার  কাকারা ইউনিয়ন। গতকাল সকাল ১০টায় এ ইউনিয়নের কাকারা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল ইসলাম সড়ক দিয়ে যেতে চোখে পড়েছে সড়কের ক্ষতবিক্ষত চিত্র। গত তিন দিন ধরে ডুবে থাকা দীর্ঘ তিন কিলোমিটার এ সড়কের আশরাফুল আযম মাদ্রাসা পর্যন্ত গিয়ে দেখা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল ইসলাম সড়কের পুরো এলাকা ভেঙে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম, আবুল কাশেম জানান, গত রোববার বিকেল থেকে  মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল ইসলাম সড়ক এবং এর আশপাশের এলাকাতে ৩-৪ ফুট পানি ছিল। বৃহস্পতিবার ভোর ৪টার মধ্যে পানি পুরোপুরি নেমে গেছে। পানি নেমে যাওয়ার পর দেখা গেছে সড়কটি ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

শাকের মোহাম্মদ চর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বসতবাড়ি থেকে  পানি নেমে গেলেও এখনও জিন্দাবাজার-কাকারা সড়ক পানিতে ডুবে আছে। মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নৌকায় চলাচল করছে।

শুধু মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল ইসলাম সড়ক কিংবা জিন্দাবাজার নয়, এভাবে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে কাকারা ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি রাস্তা-ঘাট। ঘরবাড়ি তেমন বিধ্বস্ত না হলেও বসবাসের অনুপযোগী হয়ে গেছে অনেক বসতি।

কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহাব উদ্দিন সমকালকে বলেন, এ ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি সড়ক-উপসড়ক বন্যায় ভেঙে গেছে। রাস্তা দিয়ে মানুষের হাঁটাচলা কঠিন হয়ে পড়েছে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, জেলায় সড়ক বিভাগের ৫৯ কিলোমিটার ও এলজিইডির ৮০ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার সড়ক এবং  ৪৭টি ব্রিজ ও কালভার্ট বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন খান সমকালকে বলেন, পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়ার পর এই ক্ষতি আরও বাড়তে পারে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলার ৬০টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়েছে। এতে চার লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বন্যাকবলিত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১০৩ টন চাল, ১৫ লাখ ৭৫ হাজার নগদ টাকা এবং ৫০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. শাহীন ইমরান বলেন, ১৫ দশমিক ৬৩৮ হেক্টর ফসিল জমি, ১৭৫২টি পুকুর, দিঘি, খামার এবং ১৮৩২টি মৎস্য ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে এবং এই সহযোগিতা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকব।

চকরিয়া প্রতিনিধি জানান, দক্ষিণ চট্টগ্রামের মতো কক্সবাজারের চকরিয়াতেও হাহাকার করছে দুর্গত মানুষ। ঘরবাড়িতে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় গত চার দিন ধরে লক্ষাধিক মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। গত ৭ আগস্ট থেকে গতকাল পর্যন্ত সরকারিভাবে ১৮টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার জন্য ৪৫ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৫ টন চাল রান্না করে খিচুড়ি বিতরণের জন্য বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ৪ লাখ টাকা নগদ অর্থ প্রদান করেছেন বলে জানিয়েছেন চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেপি দেওয়ান। চকরিয়ার সার্বিক অবস্থা পরিদর্শনের জন্য আজ শুক্রবার সকালে আসছেন ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান।

সুত্র: সমকাল

শেয়ার করতে পারেন খবরটি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো বিভিন্ন খবর দেখুন

Sidebar Ads

© All rights reserved © 2015 Dainik Cox's Bazar Ekattor
Theme Customized By MonsuR
x