জানে আলেম স্বপন (৫৫)। কাগজে কলমে তিনি কক্সবাজার সর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনওর) ড্রাইভার হিসেবে কর্মরত। অথচ দীর্ঘ এক যোগ ধরে স্টারলাইন পরিবহণে চাকরি করে যাচ্ছেন তিনি। তবে এতে সরকারি সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা পেতে তার কোন রকমেই অসুবিধা হচ্ছে না। অপরদিকে দীর্ঘ বছর ধরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি চলছে বহিরাগত চালক দিয়ে। বিভিন্ন সময় এক একজনকে ইউএনওর ড্রাইভার নিয়োগ দিয়েছেন গাড়ি চালক জানে আলম স্বপনই।
অভিযোগ আছে,গাড়ি না চালালেও উপজেলা ও জেলা প্রশাসনে তদবীর বাণিজ্যের সঙ্গে বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন স্বপন। একই সঙ্গে চাকরির সুবাধে পরিবহন সেক্টরের মাদকের নিয়ন্ত্রণ করেন স্বপন। তার সিন্ডিকেটের অনেকেই ধরা পড়েছেন আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীর হাতে। অবৈধ টাকায় একাধিক বিলাশবহুল বাড়ীসহ অটল সম্পদের মালিকও হয়েছেন তিনি।
এদিকে তথ্য প্রমাণসহ অভিযোগ সামনে আসার পর ব্যবস্থার পরিবর্তে রহস্যজনকভাবে গাড়ি চালক জানে আলম স্বপন যেন কোন সমস্যায় না পড়েন সে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছেন সদর উপজেলার বর্তমান নির্বাহী কর্মকর্তা।
অনুসন্ধান ও উপজেলা পরিষদের কয়েকজন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৮সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে গাড়ি চালক স্বপন তার পরিবর্তে নরুল আলম মনিয়া নামের একজনকে গাড়ি চালক হিসেবে নিয়োগ দেন। এর পর বেশ কয়েকজন চালক পরিবর্তন করেন। পরবর্তী গত ৬ বছর ধরে গাড়ি চালক হিসেবে তার ভাই মনজুর আলম। সবাইকে নিজের মত করে নিয়োগ দিয়েছেন জানে আলম স্বপ্নই। ১৯৮৪সালের ১০মে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের গাড়ি চালক পদে যোগদান করে স্বপন। আরও কয়েক বছর তার চাকরির মেয়াদ রয়েছে।
অন্যদিক সরকারি চাকরিতে বহাল থেকে গত ২০০৮ সাল থেকে স্টারলাইন পরিবহণ কক্সবাজারস্থ এজিএম হিসেবে চাকরি নেন জানে আলম স্বপন।পরে ২০১৫ সাল থেকে মহা ব্যবস্থাপক হিসেবে পদোন্নতি হয় তার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলায় কয়েকজন কর্মকর্তার দাবি, রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার বাসনা থেকে জানে আলম স্বপন মূলতো মাদকের ব্যবসার জন্য পরিবহণে সেক্টরে চাকরি নেন। কক্সবাজারের বড় বড় ইয়াবা কারবারিদের মাদক রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে নিরাপদে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন তিনি। একই সঙ্গে উপজেলা ও জেলা প্রশাসনে তদবীর বাণিজ্যের সঙ্গে স্বপন জড়িত বলে বিস্তর তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্রে জানাগেছে,গত বছর স্বপনের ছেলে ফাহিম এবং মাদক সিন্ডিকেটের সদস্য মিজান স্টার লাইন পরিবহনের করে ঢাকা যাওয়ার সময় চট্রগ্রামের সিটি গেইট এলাকায় পুলিশের চেকপোস্টে বিপুল পরিমান ইয়াবা সহ আটক হন। পরে মোটা অংকের বিনিময় ছেলে ফাহিমকে ছাড়িয়ে নেন।তবে মাদক মামলায় জেলে যেতে হয় মিজানকে। এছাড়াও মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে চাকরি গেছে স্বপনের ভাই কক্সবাজার জেলা পরিষদের গাড়ি চালক কামরুলের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্টার লাইন পরিবহনের একজন কর্মচারী দাবি করেন, পরিবহনের কক্সবাজার লাইনের যে সকল ড্রাইভার মাদক নিয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে তারা প্রায় সকলে স্বপন সিন্ডিকেটের সদস্য এবং আস্তাভাজন।
কথা হয় ইয়াবাসহ ধরা পড়ে কারাবরণ করা কয়েকজনের সঙ্গে। তাদের দাবি ,গাড়ি চালক স্বপনের মাধ্যমে পরিবহণে করে মাদকের চালান পাঠালে সহজে তা ধরা পড়ে না। রহস্যজনক কারনে গাড়ি গুলো তল্লাশি করা হয় না। তারা নিজেরও একাধিকবার সফলভাবে স্বপনের মাধ্যমে ইয়াবার চালান পাঠিয়েছেন দাবি করে তারা এখন আর ইয়াবার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নয় বলে জানান।
তারা আরও বলেন,আত্মস্বীকৃত ইয়াবা ডন খ্যাত শাহাজান আনছারি,নফরসহ কক্সবাজারে প্রায় ইয়াবা গডফাদাররা স্বপনের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছানোর ইয়াবার চালান পাঠান। তবে এ জন্য মোটা অংকের কমিশন দিতে হয় স্বপনকে।
জানা যায়,জানে আলম স্বপন ফেনী জেলার লালপুল মৃত আবুল কাশেমের পুত্র। তারা তিন ভাই কক্সবাজারের সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের গাড়ি চালক হিসেবে কর্মরত। স্বপনের বড় ভাই শাহাজান বর্তমানে কক্সবাজার গণপূর্ত অফিসের গাড়ি চালক।ছোট ভাই কামরুল জেলা পরিষদের কার্যালয়ের ড্রাইভার।তবে মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোহ কামরুলকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। এদিকে অবৈধ পন্থায় আয়ের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে যায়,কক্সবাজার শহর প্রবেশমুখ সদরের ঝিলংজা ডিক্কুলে নিজের নামে ক্রয়কৃত ৪০ শতক জমিতে বহুতল ফাউন্ডেশন দিয়ে ১ তলা পর্যন্ত একটি ভবন নির্মাণ করেছেন। সদরের ঝিলংজা পশ্চিম হাজীপাড়া এলাকায় মেয়ের নামে ২০ শতক জমিতে ৭ তলা বিশিষ্ট একটি আলিশান বাড়ি। একই এলাকায় আরো একটি ২ তলা বাড়ি করেছেন তিনি। এ ছাড়াও কক্সবাজার শহরের কলাতলিস্থ সরকারি কর্মচারীদের ৫১ একর প্লটে নিজের নামে একটি, স্ত্রীর নামে একটি,মেয়ে ও ভাইয়ের নামে দুটিসহ ৪টি প্লট কিনেছেন স্বপন। ফেনীতে থাকা স্বপনের আত্মীয় স্বজনের দাবি, খালা ও বিশ্বস্ত দুঃসম্পর্ক আত্মীয়দের নামে প্রায় ২০একরের বেশি জমি ক্রয় করেছেন।
অভিযোগ স্বীকার করে তার ভূলের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন জানে আলম স্বপন।তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমি অসুস্থতার কারনে দীর্ঘদিন ধরে ইউএনও স্যারের গাড়ি চালাতে যাইনা। এ জন্য নিজের ভাইকে সেখানে গাড়ি চালক হিসেবে দিয়েছি। স্টারলাইনে চাকরি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্টারলাইনের মালিক আলা উদ্দিন আমার মামা হয়।তাই ওনার অনুরোধে সেখানে চাকরি করছি। ২০হাজার টাকা করে সেখান থেকে বেতন পাই।তবে এখন বুঝতে পেরেছি ভুল হয়েছে। এ জন্য আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা চাই। মাদক ও তদবীর বাণিজ্যে জড়িত থাকার বিষয়ে অস্বীকার করে স্বপন বলেন যে পরিমাণ সম্পদের কথা বলা হচ্ছে আমার আসলেই কিছু নাই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও মিল্টন রায় বলেন,আমিও আসলে প্রথমে জানতাম না আমার গাড়ি চালক কে? পরে বিষয়টি জানতে পারি আমার ড্রাইভার অন্য আরেকজন।
একযুগ ধরে চাকরিতে অনুপস্থিতি ও অন্যত্রে চাকরি করা প্রসঙ্গে কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে ইউএনও বলেন, গত মাসে জানে আলম স্বপন অসুস্থ বলে জানিয়ে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার জন আবেদন করেছেন। এতে কি আর করা? তার আবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা করব।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সদর উপজেলার একজন সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন,গাড়ি চালক স্বপনের দীর্ঘদিন অনুপস্থিতি ও প্রাইভেট কোম্পানি চাকরির বিষয়টি যখন আমি প্রথম জানতে পারি। তখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করি। পরে উর্দ্ধতন মহলের চাপের কারনে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে স্বপন মাদকের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত জেনে তাকে আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিতে চেষ্টা করেছি কয়েকবার। শেষ পর্যন্ত আমার কর্মস্থল বদলী হওয়ায় তা আর সফল হয়নি।
জানে আলম স্বপন মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্টারলাইন পরিবহণের মালিক ফেনী পৌরসভার সাবেক মেয়র হাজী আলাউদ্দিন।তিনি যুগান্তরকে বলেন,স্বপন আমার আত্মীয় হয় তার এক ভাই আমার এখানে চাকরি করেন। স্বপন যেহেতু কক্সবাজারে থাকে তাই তাকে তার ডিউটি শেষে স্টারলাইন পরিবহণের দিকে একটু নজর রাখে বলা হয়েছিল।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি চালকের একযুগ ধরে চাকরিতে অনুপস্থিতি ও অন্যত্রে চাকরি করার প্রসঙ্গে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আলামিন পারভেজ যুগান্তরকে বলেন,বিষয়টি সত্য হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তদবীর বাণিজ্যের বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে জানিয়ে মাদকের অভিযোগের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আইনশৃংঙ্খলা বাহিনী দেখবেন বলে জানান তিনি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার প্রশাসন মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ড্রাইভার জানে আলম স্বপন মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকার যে অভিযোগ উঠেছে তা খতিয়ে দেখা হবে। সত্যতা পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
Leave a Reply