বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০১:০৬ পূর্বাহ্ন
কক্সবাজার ৭১ ডেস্ক:
শেখ ফজলে নূর তাপস ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হিসেবে মনোনয়ন পেলে ফাঁকা হয় ঢাকা-১০ আসন। ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত আসনটির উপনির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী নিয়ে জল্পনাকল্পনা ছিল অনেক। শেষ পর্যন্ত সবাইকে অবাক করে আসনটিতে মনোনয়ন পান পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। যদিও ঘটনাটি মোটেও আকস্মিক ছিল না। গত এক দশকে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রধান ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছেন পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। বর্তমান জাতীয় সংসদেও এক ডজনেরও বেশি জনপ্রতিনিধি রয়েছেন, যারা মূলত পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তা। তাদের কয়েকজন মন্ত্রিত্বও পেয়েছেন।
বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ব্যক্তিজীবনে বস্ত্র ও পোশাক খাতের ব্যবসায়ী। এ খাতে ব্যবসা রয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামেরও। পেশাগতভাবে পোশাক ব্যবসায়ী পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও। পোশাক খাতের নিট পণ্যের প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি একেএম সেলিম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী খুলনা-৪ আসনের এমপি। জাতীয় সংসদে বর্তমানে এমন অনেক জনপ্রতিনিধি রয়েছেন, যাদের অন্যতম পেশা পোশাক খাতের ব্যবসা। এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে এখন পর্যন্ত মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন দুজন জনপ্রতিনিধিÍপ্রয়াত আনিসুল হক ও বর্তমান মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। দুজনই পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি। সংগঠনটির আরেক সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জনপ্রতিনিধিত্ব না করলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক এবং শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক উপকমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
শুধু রাজনীতি নয়, অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি ব্যাংক খাতেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। ব্যাংক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারও একজন পোশাক ব্যবসায়ী। সব মিলিয়ে বলা চলে, সবচেয়ে শ্রমঘন ও বৃহত্তম শিল্পের প্রতিনিধিত্বকারী পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরাই এখন হয়ে উঠেছেন দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রধান কেন্দ্র।
পোশাক ব্যবসায়ীরা নিজেরাও তা স্বীকার করছেন। তাদের ভাষ্যমতে, পোশাক ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার পোশাক খাতের সঙ্গে জড়িত নয়। যদিও সবচেয়ে শ্রমঘন শিল্প পরিচালনার পাশাপাশি খাতটিকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে অনেকেরই আরো বড় পরিসরে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা তৈরি হয়েছে। সুযোগ হয়েছে সরকারের কাছাকাছি যাওয়ার।
স্বাধীনতার পর দেশের রফতানি খাত ও কর্মসংস্থানের বড় চালিকাশক্তি ছিল পাট ও চা। পরে পাট শিল্প তার আগের অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। এর বাইরে চামড়াসহ বিভিন্ন খাতে সরকার নানা প্রণোদনা ও সুযোগ-সুবিধা দিলেও শিল্পগুলো দাঁড়াতে পারেনি। অন্যদিকে পোশাক খাতের নগদ সহায়তা ২৫ থেকে কমতে কমতে এখন ৫ শতাংশে নেমেছে। তার পরও রফতানির প্রায় ৮৪ শতাংশই জুড়ে রয়েছে তৈরি পোশাক। ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতকে বিবেচনায় নিলে পোশাক শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এক থেকে পাঁচ কোটি মানুষের জীবনযাপন সম্পৃক্ত রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, পোশাক খাতের অনেক ব্যবসায়ী আছেন, যারা সংসদ সদস্য। সবাই কিন্তু পোশাক খাতের নেতৃত্ব দিয়ে সংসদ সদস্য হননি। ন্যায্যতা নিশ্চিত হওয়া ছাড়া কাউকে নেতৃত্বে নেয়া হয়নি। এছাড়া আগে রাজনীতি করেছেন, পরে ব্যবসায়ী হয়েছেন, তাদের সংখ্যাই বেশি। পরবর্তী সময়ে গত এক দশকে আমরা যারা রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রগুলোয় যুক্ত হয়েছি, আমাদের নেতৃত্বের গুণাগুণ দেখেই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যাকে যেখানে কাজে লাগানো গেছে, তাকে সেখানে কাজে লাগানো হয়েছে। আমরা দেশের জন্য কাজ করছি। ভবিষ্যতেও করব।
অনেকটা একই কথা বলছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমরা যারাই রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসা করে এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছি, তারা সবাই শূন্য থেকে উঠে এসেছি। এমন নয় যে আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে ব্যবসা পেয়েছি। অনেকেই বিজিএমইএর সভাপতিও ছিলাম। চ্যালেঞ্জ নিতে আমরা অভ্যস্ত। ফলে আজ আমরা সফল। মনে রাখতে হবে, রাজনীতি আর ব্যবসা একটি আরেকটির পরিপূরক। বিশ্বের অনেক দেশেই এখন এটা হচ্ছে। ৫০ বছর আগের পৃথিবী আর ৫০ বছর পরের পৃথিবীর মধ্যে অনেক পার্থক্য দাঁড়িয়ে গেছে। এখন যেকোনো কিছুই বৈশ্বিকভাবেই চিন্তা করতে হবে।
পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নের প্রথম ধাপই ছিল পোশাক ব্যবসা। সে হিসেবে দেশ সঠিক পথেই এগোচ্ছে। বিশেষ করে বর্তমানে যারা ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন তাদের নেতৃত্বের গুণাবলি চোখে পড়ার মতো। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যুক্ত হওয়া পোশাক ব্যবসায়ীরা দুই বছর ধরে কভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় অনেক অবদান রেখেছেন।
খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, বাংলাদেশীরা মূলত ছিলেন চাকরিজীবী। বর্তমানে দাসত্ব থেকে বেরিয়ে উদ্যোক্তা তৈরির প্রধান কেন্দ্র হলো পোশাক খাতের ব্যবসা। এটা আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পেয়েছি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। তার নেতৃত্বে একটা বাংলাদেশ পেয়েছি বলেই আমরা ব্যবসায়ী। এ শিল্পের ব্যবসায় জড়িত হয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও স্বীকৃতি পেয়েছি। শিল্পে আমাদের অবদানের মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই প্রধানমন্ত্রী আমাদের জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে দেশ পরিচালনার জন্য বড় বড় জায়গায় নিযুক্ত করছেন।
পোশাক ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশের নারীর ক্ষমতায়নেও বড় ভূমিকা রেখেছে পোশাক শিল্প। খাতটির ওপর ভর করে গড়ে উঠেছে সংশ্লিষ্ট আরো অনেক শিল্প। পরিবহন-ব্যাংক-বীমাসহ আরো অনেক খাতেই অবদান রাখছে শিল্পটি। এছাড়া খাতটির নেতারাও ব্যবসায়িক অনেক প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে বড় হয়েছেন। এছাড়া খাতটির যারা এখন নীতিনির্ধারণী জায়গায় রয়েছেন, তারা সবাই বেশ সুনামের সঙ্গেই ব্যবসা করছেন।
তবে দেশের অর্থনীতির ভরকেন্দ্র শুধু পোশাক খাতের দিকে ঝুঁকে পড়ার বিষয়টি নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা বেশি হওয়ায় অর্থনীতির নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলোও এ ব্যবসাকেই কেন্দ্র করে নেয়া হচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক বৈষম্যও বাড়ছে।
বিষয়টিকে এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখার মতো ঝুঁকিপূর্ণ বলেও মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এর প্রভাব ব্যাপক। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, আমাদের রাজনীতির ব্যবসায়ীকরণ হয়েছে। ব্যবসার রাজনৈতিকীকরণ হয়েছে। এখন রাজনীতিটাই ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ব্যবসায়ীরাই এখন সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ীরাই এখন গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় আছেন। ফলে নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলো তাদের স্বার্থেই বিবেচনা করা হয়। সাধারণ মানুষের পরিবর্তে শুধু একটা শ্রেণীর স্বার্থই দেখা হচ্ছে। এটা আসলে একটা বৈষম্যমূলক ব্যাপার এবং এর ফলে বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। এতে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে আরেকটি যে অসুবিধা হচ্ছে, বিনিয়োগের বৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলছি আমরা। ভিন্ন খাতে বিনিয়োগ বা ভিন্ন সেক্টরকে বড় করে তুলে আনার দিকে আমাদের নজর নেই। আমাদের সিংহভাগ রফতানি তৈরি পোশাক খাতের। আমাদের সব ডিম আমরা এক ঝুড়িতে রেখেছি। যদিও প্রতিটি খাত পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। শুধু নীতিমালার ক্ষেত্রে যদি একটি খাতকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হতে থাকে, তাহলে অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে পড়ে। কোনো কারণে যদি এ শিল্প ব্যাপকভাবে মার খায়, তাহলে আমরা ব্যাপক ক্ষতিরও সম্মুুখীন হব। তাই সব ডিম এক ঝুড়িতে না রেখে বৈচিত্র্য বাড়ানো উচিত।
পোশাক খাতের সঙ্গে বর্তমানে জড়িয়ে পড়েছে আরো অনেক খাত। বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ীদের অভিমত, পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক খাত ঝুঁকিতে পড়বে। তবে পোশাকের চাহিদা খাদ্যের মতো কখনই কমবে না। তাই পোশাক খাতে বিপুল বিনিয়োগও ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, এটা অস্বীকারের উপায় নেই, বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড এখন গার্মেন্টকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। গার্মেন্ট খাতের সঙ্গে জড়িত পরিবহন খাত। কাল যদি গার্মেন্ট বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে পরিবহন খাতের এক কোটি লোক রাস্তায় বসে যাবে। এ খাতের সঙ্গে সরাসরি অন্তত পাঁচ কোটি মানুষ জড়িত। গার্মেন্টের সঙ্গে ব্যাংক সেক্টরও জড়িত। আমার এক্সিম ব্যাংকে গার্মেন্ট শ্রমিকদের সাড়ে চারশ অ্যাকাউন্ট আছে। আমাদের আসল আয়টা ওখান থেকে আসে। ইসলামী ব্যাংকেও আছে। একটা গার্মেন্ট অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িত। এ খাতের মধ্যে যারা মেধাবী, যাদের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা আছে, তারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে যাচ্ছেন। আমি মনে করি, এটা তাদের অর্জন। তবে আমি মনে করি, এতে দেশের অর্থনীতি কোনো ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে না। বরং গার্মেন্ট শিল্প ভালো আছে বলেই আজকের অর্থনীতি এত ভালো চলছে।