রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৫১ পূর্বাহ্ন
কক্সবাজার ৭১ ডেস্ক:
আমার ভবনের সামনে ড্রেনের জন্য মাটি খুঁড়া হয়েছে পক্ষকাল আগে। নিচে বেইজটা ঢালাই দেয়ার সপ্তাহ পর তিনজন শ্রমিক রড বেঁধেছে সারাদিন। এখন সেভাবেই পড়ে আছে চারদিন হলো। কবে পুরো কাজ শেষ হবে বুঝতে পারছি না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আমাদের সাথে তামাশা করছে। ক্ষোভ নিয়ে এভাবেই কথা গুলো বলেছেন কক্সবাজার প্রধান সড়কের আছাদ কমপ্লেক্সের স্বত্বাধিকারী খোরশেদ আলম।
শুধু তার মার্কেটের সামনে নয়, সিংহভাগ এলাকার অবস্থা একই। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায়সারা মনোভাব আর কর্তৃপক্ষের উদাসিনতাকে এ জন্য দায়ি বলে মনে করেন পৌরবাসি। পর্যাপ্ত শ্রমিক দিয়ে কচ্ছপ গতির কাজে জনদূর্ভোগ দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলেও দাবি করেছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দরপত্রের কার্যাদেশ অনুসারে কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়ক উন্নয়ন কাজ ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষ হবার কথা। কিন্তু কাজ শুরুর এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো ড্রেইনের কাজই শেষ করতে পারেনি কার্যাদেশ পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া সড়কে এক সাথে প্রায় সব স্থানে ড্রেনেরে কাজ শুরু করলেও হাতে-গোনা কয়েকজন শ্রমিক দিয়ে মন্থরগতিতে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দীর্ঘায়িত হচ্ছে জনদূর্ভোগ, ঘটছে দূর্ঘটনাও। আর লেগেই আছে যানজট।
তবে, সড়ক বাস্তবায়নকারি প্রতিষ্ঠান কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) বলছে নির্দ্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে বার বার তাগাদা দেয়া হচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। আর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকাসহ নানা প্রতিবন্ধকতাকে দায়ি করেছেন।
ছবি-হাশেমিয়া মাদ্রাসার সামনের ড্রেন।
সূত্র মতে, এক সময়ের সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের আওতাধীন থাকা জনগুরুত্বপূর্ণ কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কটি প্রশস্তকরণ প্রকল্প হাতে নেয় ২০১৬ সালে যাত্রা হওয়া কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক)। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধিনে ‘হলিডে মোড়-বাজারঘাটা-লারপাড়া (বাসস্ট্যান্ড)’ সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পে ৪ দশমিক ৬৬ কিলোমিটার সড়কের ব্যয় ধরা হয়েছে একশ ৮২ কোটি ৭২ লাখ ৩৮ হাজার ৩০৮ দশমিক ৭৮৫ টাকা। সড়ক নির্মাণ শেষে সৌন্দর্য্য বর্ধণ প্রকল্পসহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করতে আরো ৬৬ কোটি ১০ লাখ টাকা বাড়তি বরাদ্দ দেয়া হয়েরছ। সব মিলিয়ে কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কের নতুন অবয়ব দিতে সরকার ব্যয় করছে ২৫৮ কেটি ৮২ লাখ টাকা।
২০১৯ সালের ১৬ জুলাইয়ে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পাবার পর দরপত্র আহ্বান করে কউক। দু’ভাগে বিভক্ত প্রকল্পটিতে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজ পেয়েছে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (এনডিই) এবং তাহের ব্রাদার্স নামে দুটি প্রতিষ্টান। এনডিই অনুমতি পেয়েছে ‘হাশেমিয়া মাদ্রাসা হতে হলিডে মোড়’ ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার কাজের। কার্যাদেশ অনুযায়ী ২০২২ সালের জুলাই মাস কাজ বুঝে দেয়ার কথা তাদের। আর তাহের ব্রাদার্স পেয়েছে প্রকল্পের ‘হাশেমিয়া মাদ্রাসা হতে বাসস্ট্যান্ড’ ২ দশমিক ২১০ কিলোমিটার সড়কের কাজ। তারাও কাজ বুঝিয়ে দেবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে।
কিন্তু ২০২০ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে কাজ শুরুর ১৪ মাস অতিক্রম হলেও এখনো ড্রেইন তৈরীর কাজও সমাপ্ত করতে পারেনি প্রতিষ্টান দুটি। উল্টো পরিকল্পনাহীন কুঁড়াখুঁড়ির ফলে শহরের অভ্যন্তরে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আদালত ও সরকারি দপ্তর বেষ্টিত এলাকা হিসেবে সবচেয়ে কাহিল অবস্থা ‘হাশেমিয়া মাদ্রাসা হতে হলিডে মোড়’ সড়ক এলাকায়। কিছু কিছু স্থানে হাতে গোনা কয়েকজন শ্রমিক দিয়ে ড্রেনের কাজ করা হচ্ছে। কচ্ছপগতির কাজে ভোগান্তি বেড়েছে পৌরবাসি, জেলা প্রশাসন অফিসে আসা সেবাপ্রার্থীদের। ঘটছে দূর্ঘটনাও। সবচেয়ে বেশি ভেগান্তিতে পড়েছেন ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী, মুমূর্ষু রোগী, গর্ভবতীরা।
ছবি-মন্দিরের সামনের ড্রেন।
দেখা যায়, প্রায় সবস্থানে ড্রেনের জন্য মাটি খুঁড়ে রেখেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। নিউ মার্কেটের পর হতে হলিড়ে মোড় পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটারের চেয়ে বেশি এলাকায় খুঁড়ে রাখা ড্রেনের কাজ করছেন নামে মাত্র কয়েকজন শ্রমিক। অনেকাংশে বেঁধে রাখা লোহাগুলো উন্মূখ হয়ে আছে। সপ্তাহ থেকে পক্ষকাল এভাবে পড়ে আছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট এলাকার ব্যবসায়ী ও পথচারিরা। একারণে সড়কে হাঁটা-চলাও দুরূহ হয়ে পড়ছে। প্রধান সড়কের পাশাপাশি উপসড়কগুলোও একসাথে কাজ শুরু করায় নাভিশ্বাস উঠেছে স্থানীয় অধিবাসী ও পথচারিদের। বিকল্প পথ না থাকায় জরুরী প্রয়োজনে সড়কে চলতে গিয়ে দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে।
টমটম চালক রহিম উল্লাহ বলেন, গেল এক বছরে তিনবার গাড়ির স্প্রিং সেট বদলাতে হয়েছে। যানজটে আটকে থাকতে হয় ঘন্টার পর ঘন্টা। পেটের দায় না থাকলে ঘর থেকে বের হতাম না। দুঃখের বিষয় হচ্ছে যেভাবে সড়কের কাজ হচ্ছে, তাতে মনে হয় শুধু ড্রেনের কাজ শেষ করতে সময় লাগবে আরো একবছর।
ব্যবসায়ী আসহাব উদ্দিন বলেন, সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সড়কের সবস্থানে খুঁড়ে ফেলে রেখেছে। দুয়েকজন শ্রমিক দিয়ে লোহা বাঁধার কাজ করা হয়। দোকানের সামনে গর্ত থাকায় দোকান খুললেও, ক্রেতা আসার সুযোগ হয় না।
ছবি-যানজটে এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ির উপর বসে থাকতে হয় যাত্রীদের।
শিক্ষার্থীরা সাইমন জানান, করোনা পরবর্তী নতুন বছরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছে। কিন্তু শহরে সড়কের দুরাবস্থায় সঠিক সময় শিক্ষা প্রতিষ্টানে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। পথেই অন্তত দুই ঘন্টা সময় নষ্ট হয়।
হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রুমালিয়ারছড়ার নুরুল জুসেফ নামের রোগীর অভিভাবক বলেন, আমার বাসা থেকে হাসপাতালের দূরত্ব ৫০০গজ। নরমালি হাসপাতালে পৌঁছাতে সময় লাগার কথা ১৫ মিনিট। কিন্তু অসুস্থ বোনকে নিয়ে বাসা থেকে হাসপাতালে পৌছাতে সময় লেগেছে প্রায় দেড় ঘন্টা। এ অবস্থায় সংকটাপন্ন রোগী হলে পথেই মৃত্যু হতো।
এ ভোগান্তির পেছনে পৌরসভা ও কউকের সমন্বয়হীনতাকে দায়ি করেছেন সচেতন মহল। তাদের মতে, যেসময়ে প্রধান সড়কের কাজ শুরু হয়েছে সেই সময়ে শহরের বিভিন্ন উপ-সড়কের কাজও আরম্ভ করে পৌরসভা। একই সাথে প্রধান ও উপসড়ক চলাচল অনুপযোগী হওয়ায় দূর্ভোগ বেড়েছে কয়েকগুণ।
সম্প্রতি কউকের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো এক চিঠিতে পৌর প্রশাসনের অসহযোগিতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রকৌশল) ও প্রধান সড়ক প্রসস্থকরণ প্রকল্পের পরিচালক লে. কর্ণেল মো. খিজির খান বলেন, কার্যাদেশ অনুসারে কাজ শেষ হতে সময় থাকলেও মানুষের ভোগান্তি দেখে দ্রুত কাজ শেষ করতে বার বার তাগাদা দেয়া হচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। তাদের নিয়ে অনেকবার বসে আলাপ হয়েছে। কিভাবে কাজ শেষ করা যায়। কিন্তু প্রায় জায়গায় খুঁড়া কাজগুলো দ্রুত সমাপ্ত না করায় অপরিকল্পিত কাজের অভিযোগ প্রায় আসছে আমাদের কাছে। কাজ বুঝে না দেয়া পর্যন্ত এর দায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের।
ছবি-লালদীঘি পর্বপাড় বিলকিস মার্কেটের সামনের ড্রেন।
লে. কর্ণেল মো. খিজির খানের অফিসে দেখা হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (এনডিই)’র প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর প্রকৌশলী আরিফুর রহমানের সাথে।
কথা হলে, কাজে ধীর গতির বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, প্রধান সড়কের কাজ করতে গিয়ে নির্মাণ সামগ্রী পরিবহণ করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলে ভিন্ন স্থানে প্রাথমিক কাজ শেষ করে ঢালাইসহ অন্যন্য কাজ করতে আমাদের ব্যয়ভার বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি টানা কাজ করা অনেক শ্রমিকের ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হবার ঘটনাও আছে। তাই একটু ভোগান্তি হচ্ছে। আশা করছি আমরা নির্দ্দিষ্ট সময় কাজ শেষ করতে পারবো।
কিন্তু সবখানে ড্রেইন খুঁড়ে ফেলে রাখলেও পর্যাপ্ত শ্রমিক ব্যবহার না করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কোন উত্তর না দিয়ে অফিসিয়ালি কাজের অজুহাত দেখিয়ে চেয়ার ছেড়ে দ্রুত অফিস ত্যাগ করেন এনডিই এর এ কর্মকর্তা।
সূত্র: আলোকিত কক্সবাজার।