শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৫৮ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
চকরিয়ায় বিশেষ অভিযানে ইউপি সদস্যসহ গ্রেফতার ৯ মানহানিকর সংবাদ প্রচার করায় জেলা ছাত্র দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফাহিমুর রহমানের বিবৃতি পোকার আক্রমণে বিবর্ণ মহেশখালীর প্যারাবন মহেশখালীর ঘটিভাঙ্গা-সোনাদিয়া সড়কের উপর অবৈধ ভাবে তৈরি করা হচ্ছে ব্যক্তিগত কাঠের রাস্তা শেখ হাসিনার পতনের ঘটনায় প্রশাসনিক নিরবতাকে কাজে লাগিয়ে খাস জমি দখল করে প্রতিযোগিতা মূলকভাবে নির্মাণ হচ্ছে অনুমোদনহীন বহুতল ভবন। যেন দেখার কেউ নাই হোটেল বেলাভূমি ও হোটেল ক্লাসিক সহ কটেজ জোনে অভিযান পরিচালনা করায়, কক্সবাজার জেলা পুলিশ ও জেলা গোয়েন্দা সংস্থা ডিবি পুলিশের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার সাবেক মুখ্য সচিব নাসের ও সচিব মেজবাহ গ্রেফতার মহেশখালীতে অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধার পর্যটন নগরী কক্সবাজারের হোটেল বেলাভূমি ও হোটেল ক্লাসিক এখন পতিতা, মরণ নেশা ইয়াবা ও মাদকের স্বর্গরাজ্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে রোগী কল্যাণ সমিতি পুনর্গঠন

রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুঃ বিদ্বেষ-বন্দনা বনাম ঐতিহাসিক সত্য

অনলাইন ডেস্ক:

রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। এজন্যে তিনি পুলিশি নির্যাতন ও জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। তাঁর এই অবদানকে অনেকে খণ্ডিত ও বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছেন, অনেকে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ও আদর্শিক ভিন্নতার কারণে খাটো করে দেখার প্রয়াস চালিয়েছেন, কারও কারও মূল্যায়নে পাওয়া যায় স্ববিরোধিতা, কেউ আবার স্তুতি-বন্দনা করতে গিয়ে করেছেন অতিরঞ্জন; এই বিদ্বেষ-বন্দনা উভয় কারণেই ঘটেছে ইতিহাস-বিকৃতি। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, ভাষা-আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে খণ্ডিত, বিকৃত ও খাটো করে যারা উপস্থাপন করেছেন, তাঁদের কেউ তাঁর সমসাময়িক রাজনৈতিক সহযোদ্ধা হয়েও পরবর্তীকালে রাজনীতির মঞ্চ থেকে ছিটকে পড়েছেন, কেউ আজীবন মুজিব-বিদ্বেষী, কেউ রাজনীতির মাঠের সরাসরি প্রতিযোগী, কেউ কেউ সম্পূর্ণ ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ লালনকারী, আবার কেউ সুযোগ-সন্ধানী; ফলে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিষয়ে তাঁদের মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ কখনো একদেশদর্শিতা দ্বারা আবার কখনো ঈর্ষা, অন্ধ-বিদ্বেষ ও স্তুতি-বন্দনা দ্বারা আচ্ছন্ন। তাঁদের সেসব তথ্য ও বক্তব্য পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদন, বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি, সমসাময়িক পত্রপত্রিকার বিবরণ, ভাষা-আন্দোলনের নানা দলিলপত্র, ভাষাসংগ্রামীদের স্মৃতিচারণ প্রভৃতির আলোকে আলোকে যাচাই করা হলো।

অলি আহাদ, আবদুল মতিন, আহমদ রফিক ও বদরুদ্দীন উমরের বক্তব্য যাচাই

রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খণ্ডিত ও বিকৃত করতে যাঁরা লেখনী ধারণ করেছেন তাঁদের মধ্যে অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, মোহাম্মদ সুলতান, আবদুল মতিন, আহমদ রফিক, বদরুদ্দীন উমর প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মোহাম্মদ তোয়াহা এবং বদরুদ্দীন উমর ১৯৪৮ সালের ভাষা-আন্দোলনে শেখ মুজিবের অবদান প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে গিয়ে অনেক সময় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের আশ্রয় নিয়ে ইতিহাসের সত্যকে আড়ালের চেষ্টা করেছেন। বদরুদ্দীন উমর ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভায় শেখ মুজিবের সভাপতিত্ব করার ঘটনাটি ভিন্নভাবে তুলে ধরেছেন। ঐ সভায় তাঁর সভাপতিত্ব করা বিষয়ে বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন : ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ সভার নির্ধারিত সময়ের কিছু পূর্বেই বেলা দেড়টার সময় শেখ মুজিবুর রহমান কালো শেরওয়ানী এবং জিন্নাহ টুপী পরিহিত হয়ে একটি হাতলবিহীন চেয়ারে সভাপতির আসন অধিকার করে বসেন। সেই সভায় তাঁর সভাপতিত্ব করার কোন কথা ছিলো না কারণ ঢাকার তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে তাঁর ভূমিকা ছিলো নিতান্ত নগণ্য। কিন্তু এ সত্ত্বেও তিনি নিজেই সেই সভায় সভাপতিত্ব করার সিদ্ধান্ত নেন এবং নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই সভাপতির চেয়ার দখল করেন।’ (পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৯৬)

যাঁর সাক্ষাৎকারের সূত্র ধরে বদরুদ্দীন উমর এ যুক্তি তুলে ধরেছেন তিনি হলেন মোহাম্মদ তোয়াহা, যিনি আজীবন ছিলেন অতিমাত্রায় মুজিব-বিদ্বেষী। তোয়াহার সমালোচনায় শেখ মুজিবের রাজনৈতিক অবদান অস্বীকারের প্রবণতা তো ছিলই, তাঁর নেতৃত্বে সংঘটিত একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকে তোয়াহা ও তাঁর দল ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বলে অভিহিত করেছে। ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভায় তাঁর সভাপতিত্ব করা প্রসঙ্গে তোয়াহা লিখেছেন : ‘সেদিন (১৬ই মার্চ) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মিটিং হওয়ার কথা ছিল। সেটিতে কথা ছিল আমার সভাপতিত্ব করার। নির্ধারিত সময়ের একটু আগে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি শেখ মুজিবুর রহমান একটা কালো শেরওয়ানী এবং জিন্নাহ টুপী পরে একটা হাতল বিহীন কাঠের চেয়ারে বসে আছে। তাকে ঐভাবে সভাপতির চেয়ারে বসে থাকতে দেখে খুবই আশ্চর্য হলাম। যাই হোক আমি সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। সভাস্থলে তখন আন্দাজ ১৫০ জন লোক ছিলো। এই সময় হঠাৎ করে মুজিব উঠে দাঁড়িয়ে একটা বক্তৃতা শুরু করে দিল। বক্তৃতার সারমর্ম কিছুই ছিল না। ছোট বক্তৃতার পর সে অন্য কাউকে বক্তৃতার সুযোগ না দিয়ে চিৎকার করে উঠলো, ‘চলো চলো এ্যাসেমব্লি চলো।’ (উদ্ধৃত, বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ : কতিপয় দলিল-২, পৃ. ২৬৪-২৬৬)

বদরুদ্দীন উমর ও মোহাম্মদ তোয়াহার এ বক্তব্যে ১৬ মার্চের সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্ব করার বিষয় ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, যা ঐদিনের ঘটনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ঐ সভায় উপস্থিত তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্য নেতৃবৃন্দের বিবরণের সঙ্গে মোহাম্মদ তোয়াহা এবং বদরুদ্দীন উমরের বিবরণের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। মোহাম্মদ তোয়াহার বিবরণ অসংলগ্ন, তাতে তারিখ ও ঘটনার যেমন অসঙ্গতি রয়েছে তেমনি একই ঘটনা একেক সময় একেকভাবে উপস্থাপন করার প্রবণতাও লক্ষণীয়। তিনি ঐ দিনের সভা শুরুর কথা বলেছেন ১১টায়, কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘বেলা দেড়টায় সভা শুরু হলো’; তোয়াহা এ সভায় নিজের সভাপতি নির্ধারিত থাকার কথা উল্লেখ করেছেন, যা আর কারো লেখায় উল্লেখ নেই; তিনি বলেছেন, নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে করা চুক্তি বিষয়ে শেখ মুজিব কিছু জানতো না, কিন্তু রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সকল নেতাই বলেছেন চুক্তির খসড়া কারাবন্দি শেখ মুজিবসহ অন্য নেতৃবৃন্দের অনুমোদন নেওয়া হয়; তিনি বলেছেন, কাউকে কথা বলার সুযোগ দেয়নি মুজিব, অন্যরা বলেছেন অনেকেই সেদিন বক্তৃতা দিয়েছে; তোয়াহা বলেছেন, শেখ মুজিব পার্লামেন্টারি পার্টির লোকজনের প্ররোচনায় ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেছেন, এ কথা আর কেউ বলেননি; তিনি বলেছেন, শেখ মুজিব জিন্নাহ টুপি ও শেরওয়ানী পরে ঐ সভায় একটি হাতলবিহীন চেয়ারে বসে সভাপতিত্ব করেন, অন্য কারও লেখায় বা স্মৃতিচারণে এ বিবরণ আসেনি; তিনি বলেছেন, ঢাকার ছাত্রসমাজে শেখ মুজিবের পরিচিতি ছিল নগণ্য, কিন্তু সমসাময়িক ইতিহাস তা বলে না। এসব তথ্যই প্রমাণ করে ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় শেখ মুজিবের সভাপতিত্ব প্রসঙ্গে মোহাম্মদ তোয়াহার বক্তব্য তথ্যপূর্ণ ও ইতিহাসের বাস্তব ঘটনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ বিষয়ে বদরুদ্দীন উমর যেহেতু মোহাম্মদ তোয়াহার বিবরণকেই সাক্ষ্য মেনেছেন সেজন্য তাঁর বক্তব্যও গ্রহণযোগ্য নয়। ঐ দিনের ঘটনাপ্রবাহ এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, শওকত আলী, গাজীউল হক প্রমুখের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বদরুদ্দীন উমরের বিবরণ অসার এবং উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে হয়।

মোহাম্মদ তোয়াহা ও বদরুদ্দীন উমর কথিত, শেখ মুজিবুর রহমান ‘নিজেই সেই সভায় সভাপতিত্ব করার সিদ্ধান্ত নেন’ এ কথাটি ঠিক নয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং মোহাম্মদ তোয়াহা কোথাও এ কথা বলেননি। তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতেও এ ধরনের কথা উল্লেখ নেই। উপস্থিত ছাত্রদের সম্মতিতে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ সভাপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিব নিজে বলেছেন : ‘১৬ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ে সভার সময় কে সভাপতিত্ব করবে তাই নিয়ে একটা বিতর্ক হয়। কেউ আমার নাম, কেউ শামসুল হকের নাম, কেউ বা আবার কমিটি অব অ্যাকশনের কারো কারো নাম প্রস্তাব করলো। কিন্তু সভা আরম্ভ করার পর নঈমুদ্দীন আমার নাম প্রস্তাব করে এবং সেখানে কোনো আপত্তি ওঠে না।’ (‘ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ’, ভালোবাসি মাতৃভাষা, পৃ. ৩)

বদরুদ্দীন উমর ও মোহাম্মদ তোয়াহা বলেছেন, ‘ঢাকার তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে তাঁর ভূমিকা ছিলো নিতান্ত নগণ্য।’ তাঁদের এ বক্তব্যও যুক্তিগ্রাহ্য নয়। কারণ গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন এবং এসব সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়া ও ১১ মার্চের ধর্মঘটে শেখ মুজিবের অগ্রণী ভূমিকা প্রমাণ করে তখনকার ছাত্র আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা-আন্দোলনের প্রথম পর্বে পূর্ববঙ্গের ছাত্ররাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। আর তা না হলে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে বলা হতো না যে, He took very active part in the agitation for adopting Bengali as the State language of Pakistan, and made propoganda at Dacca for general strike on 11.3.48. on this issue. On 11.3.48 the subject was arrested fo violating orders under section 144 Cr. P.C. (Secret  Documents of Intelligence Branch on Father of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Volume-1 (1948-19750),  p. 319

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সচিবালয়ের গেটে মাটিতে শুয়ে ছাত্রদের অবস্থান ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সচিবালয়ের গেটে মাটিতে শুয়ে ছাত্রদের অবস্থান ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

কাজেই মোহাম্মদ তোয়াহা এবং বদরুদ্দীন উমর ১৬ মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভার বিবরণে শেখ মুজিবের যে চিত্র অঙ্কনের চেষ্টা করেছেন, তা সমর্থন করা যায় না। ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চের ঘটনা সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতে যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা সবচেয়ে বস্তুনিষ্ঠ বলে গ্রহণ করা যায়। তিনি লিখেছেন : ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বেলা দেড়টায় সভা শুরু হলো। মুজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করলেন। সংশোধনীগুলি গৃহীত হলো। যদিও সংগ্রাম কমিটির কোনো কর্মসূচি ছিল না, তবু এসেম্বলি হাউস অভিমুখে ছাত্রদের একটা বিক্ষোভ মিছিল পরিচালিত হলো এবং সরকারি দলের এমএলএদের নিন্দা করে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করল। এএসই মেইন হোস্টেলের একটা রুমে মিলিত হলাম। পাঁচটা পর্যন্ত সেখানে থাকলাম। পরে ছাত্রদের এমএলএদের ‘ধর ধর’ শব্দে রুম থেকে বের হলাম। এর ফলে এসেম্বলি হল থেকে সরকারি দলের অনেক এমএলএ বের হলো না। ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় মি. গফুর ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রহমতুল্লাহর নেতৃত্বে একদল পুলিশ এসে ছাত্রদের ওপর লাঠিচার্জ, ফাঁকা গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ল। তারা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরেও গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ল। লাঠিচার্জে ১৯ জন মারাত্মকভাবে আহত হলো। শওকত তাদের অন্যতম। (তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৪৭-১৯৪৮, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২৩১)

মোহাম্মদ তোয়াহা এবং বদরুদ্দীন উমর ১৯৪৮ সালের ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, একইভাবে ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে তাঁর অবদান-প্রসঙ্গে যুক্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তাঁদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আহমদ রফিক এবং মোহাম্মদ সুলতানও ঢালাওভাবে বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তাঁরা বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে তাঁর যুক্ত থাকা এবং কারাগার থেকে ছাত্রনেতাদের নির্দেশনা প্রদানের বিষয়টিকে ইতিহাসের ‘কল্পকাহিনী’, ‘ইতিহাস বিকৃত করার অনাচারী প্রবণতা’, ‘মনগড়া বক্তব্য’ প্রভৃতি বলে অভিহিত করেছেন। অলি আহাদ তাঁর জাতীয় রাজনীতি : ১৯৪৫ থেকে ’৭৫ গ্রন্থে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নিজের সাক্ষাৎ করা প্রসঙ্গ উল্লেখ করলেও, সার্বিকভাবে বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে তাঁর অবদানকে অস্বীকার করে লিখেছেন : ‘শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি কারামুক্তি পেলেন। কিন্তু ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ আন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে ঢাকায় এলেন না নেতৃত্ব দিতে। বিদ্রোহের অনলে ঝাপও দিলেন না। এমন কি খুনী শাসক নূরুল আমীনের বিরুদ্ধে ৫ই মার্চ দেশব্যাপী যে হরতালের ডাক দেওয়া হয় শেখ মুজিব তাতে অংশগ্রহণ করে মারমুখো জনতাকে নেতৃত্ব দিতে ঢাকায় আসেন নাই। তারপরও মুখপোড়া আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় দালাল চামচারা বলে ১৯৫২ সালে শেখ মুজিবর নাকি ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। ধিক তাদেরকে।’ (জাতীয় রাজনীতি : ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, পৃ. ১৪৭) প্রায় একই ধরনের মন্তব্য আবদুল মতিন, আহমদ রফিক এবং বদরুদ্দীন উমরের লেখাতেও পাওয়া যায়। আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও তাৎপর্য গ্রন্থের ৪র্থ অধ্যায়ের ‘ইতিহাস নিয়ে কল্পকাহিনী’ অংশে লিখেছেন :

‘বলা বাহুল্য তাদের মুক্তির জন্য রাজনৈতিক চাপ, ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা এবং সর্বোপরি তাদের অনশন ধর্মঘটের কারণে সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি মহিউদ্দিন আহমদকে ফরিদপুর জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। আন্দোলন তখনও চলছে। কিন্তু সদ্যমুক্ত শেখ মুজিব সাহেব তখন ঢাকায় এসে আন্দোলনে যোগ না দিয়ে সম্ভবত স্বাস্থ্যগত কারণে তার গ্রামের বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন (আজাদ, ৮-২-৫২)। শুধু তাই নয়, দুই মাস পর নতুন করে গঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভায় শেখ সাহেবের বক্তব্য থেকেও এই ঘটনা সঠিক মনে হয়। তিনি বলেন : ‘দীর্ঘ আড়াই বছর কারাবাসের পর আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা যখন ভাষা সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, আমি তখন কারাগারে অনশনরত।’ এমনি একাধিক তথ্য থেকে বোঝা যায় যে, একুশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল না। অথচ দীর্ঘকাল পর বৃথাই একুশের আন্দোলনে তার ভূমিকা নিয়ে ‘মিথ’ তৈরির চেষ্টা চলছে, ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে, সে চেষ্টা এখনো চলছে এবং এজন্য দায়ী কয়েকজন স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি। এতে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। (ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও তাৎপর্য, সাহিত্য প্রকাশ, তৃতীয় সংস্করণ, ২০০৫; পৃ. ৮৫-৮৬)

বায়ান্নতে কারাবন্দি বঙ্গবন্ধু।বায়ান্নতে কারাবন্দি বঙ্গবন্ধু।

বদরুদ্দীন উমর ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ (তৃতীয় খণ্ড) গ্রন্থে ১৯৫২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে শেখ মুজিবের একটি চিঠি আসার কথা উল্লেখ করলেও পরবর্তীকালে দেশ পত্রিকাসহ বিভিন্ন পত্রিকায় ভাষা-আন্দোলনে তাঁর অবদান অস্বীকার করে বলেছেন : ‘শেখ মুজিব ফরিদপুর জেল থেকে মুক্তি লাভ করে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, যে সময়ে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকারীদেরকে বিপুল সংখ্যায় গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির অনেক সদস্য আত্মগোপন করে আছেন। এই পরিস্থিতিতে জেল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি লাভ থেকেই প্রমাণিত হয় যে তৎকালীন ভাষা আন্দোলনে তারও কোন ভূমিকা ছিল না এবং আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে মুক্তি দেওয়াটা সরকার নিজেদের জন্য অসুবিধাজনক বা বিপজ্জনক কিছুই মনে করেনি।’ (দেশ, কলকাতা : ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮)

অলি আহাদ, আবদুল মতিন, আহমদ রফিক ও বদরুদ্দীন উমরের উপর্যুক্ত বক্তব্যগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাতে তথ্যবিভ্রাট যেমন আছে তেমনি আছে খণ্ডিত তথ্য। তাঁরা ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান অস্বীকারে যা বলতে চেয়েছেন তা হলো—১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান কারামুক্ত হয়ে ঢাকায় এসে ভাষা-আন্দোলনে যুক্ত হননি। তাঁদের দাবি ভাষা-আন্দোলন ‘তখনও চলছে’, তাই ঐ সময় তাঁর মুক্তি পাওয়াটা প্রমাণ করে আন্দোলনে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল না। আরও বলেছেন, কারাগার থেকে বায়ান্নর ফেব্রুয়ারির তুঙ্গ মুহূর্তের আন্দোলন বিষয়ে তার নির্দেশনা প্রদানের বিষয়টি যথার্থ নয়। এছাড়া কারাগার থেকে মুক্তির ২ মাস পর ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে’র সভায় শেখ মুজিবুর রহমান যে বক্তব্য দেন, তার ফলে তাঁরা ৫২-র ভাষা-আন্দোলনে তাঁর যুক্ত না থাকার ‘ঘটনা সঠিক’ বলে মনে করেছেন। তাঁদের এ জাতীয় বক্তব্য খণ্ডন করার পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। ১৯৫২ সালের পুরো ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে তাঁদের এসব বক্তব্য অযৌক্তিক, খণ্ডিত, একপেশে, স্ববিরোধিতাপূর্ণ এবং ইতিহাসের প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করে ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপপ্রয়াস বলে মনে হয়। তাঁদের বক্তব্য ও যুক্তি কতটা ভিত্তিহীন তা এখানে তথ্য-প্রমাণসহ তুলে ধরা হলো।

শেখ মুজিবরের অনশন ধর্মঘটশেখ মুজিবরের অনশন ধর্মঘটপ্রথমত : অলি আহাদ, আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পান ২৬ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এ তথ্য ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্তির আদেশ পান ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে আর মুক্তি লাভ করেন ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২।

দ্বিতীয়ত : তাঁরা বলেছেন, মুক্তিলাভের পর শেখ মুজিব কেন ঢাকায় এসে ভাষা-আন্দোলনে যোগ দিলেন না। কিন্তু ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তো ভাষা-আন্দোলনের কর্মসূচি চলমানই ছিল না (যদিও আহমদ রফিক ও আবদুল মতিন বলেছেন, ‘আন্দোলন তখনও চলছে)। ঐ সময়ের ঘটনাপ্রবাহ অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে গ্রেপ্তার হন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আবুল হাশিম, খয়রাত হোসেন, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, মনোরঞ্জন ধর এবং গোবিন্দলাল ব্যানার্জী। ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, ড. পিসি চক্রবর্তী এবং জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক অজিত কুমার গুহকে। ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সভায় ‘২৬. ২. ৫২ তারিখ থেকে সাধারণ ধর্মঘট প্রত্যাহার’ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সে অনুযায়ী ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা শহরের সর্বত্র স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়। তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতে এ বিবরণ উল্লেখ আছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তারিখে তিনি লিখেছেন : ‘সেন্ট্রাল কমিটি অব অ্যাকশন ও সিভিল লিবার্টিস কো-অর্ডিনেটিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ থেকে শহরের সর্বত্র স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হলো। লাগাতার ৫দিন ধর্মঘট চলার পর রিকশাওয়ালাদের মতো দরিদ্র জনগণ তাদের বিরাম দেওয়ার জন্য আমাদের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করল।’ (তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৫২, চতুর্থ খণ্ড, পৃ. ৫৪)

২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ হলের হাউস-টিউটর ড. মফিজউদ্দিন আহমদসহ ৩০ জন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে এবং মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণের শহিদ মিনার ভেঙে ফেলে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি এক গেজেট প্রকাশ করে কাজী গোলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খান, শামসুল হক, অলি আহাদ, আবদুল মতিন, সৈয়দ এম নূরুল আলম, আজিজ আহমদ, আবদুল আওয়াল ও মোহাম্মদ তোয়াহাকে এক মাসের মধ্যে নিজ স্ব-স্ব জেলা প্রশাসকের কাছে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। এমন পরিস্থিতিতে এ সময় ভাষা-আন্দোলনের নতুন কোনো কর্মসূচি ছিল না, নেতাদের প্রায় সবাই গাঢাকা দিয়েছেন, কাউকেই ঐ সময় রাজপথে দেখা যায়নি। শেখ মুজিবের মুক্তির সপ্তাহ খানেক পর, অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ৭ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য গোপীনগরের এক বাড়িতে গোপন বৈঠক করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন।

তৃতীয়ত : তাঁরা বলেছেন, যখন সকলকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তখন শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া প্রমাণ করে ভাষা আন্দোলনে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল না। তাঁরা এও বলতে চেয়েছেন যে, শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া আন্দোলনের জন্য বিপজ্জনক মনে করেনি সরকার। কিন্তু একটু তথ্য-প্রমাণ হাজির করলেই দেখা যায়, তাঁদের এ বক্তব্য যুক্তিহীন, স্ববিরোধিতাপূর্ণ এবং বিভ্রান্তিকর। আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক নিজেরাই শেখ মুজিবের মুক্তির পেছনে ‘রাজনৈতিক চাপ’, ‘ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা’ এবং ‘সর্বোপরি তাদের অনশন ধর্মঘটের’ কথা উল্লেখ করেছেন। বাস্তবেই শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশেই আন্দোলন হয়েছে। তাছাড়া টানা এক সপ্তাহের বেশি অনশনে তাঁর শারীরিক অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয় পড়ে। ফলে বাধ্য হয়েই সরকার শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন আহমেদকে মুক্তি দেয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির পূর্ব থেকেই অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা শহরে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে। তাছাড়া সরকার শেখ মুজিবকে মুক্তি দিলেও তাঁর ওপর ছিল রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পুলিশি নজরদারি। অবস্থা এমন ছিল যে, কারাগার থেকে মুক্ত হলেও প্রকারান্তরে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন গৃহবন্দি। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনসূত্রে এ তথ্য জানা যায়। ১৯৫২ সালের ১ মার্চ পূর্ববঙ্গ পুলিশের আইজি এ কে এম হাফিজুদ্দীন এক টেলিগ্রামে শেখ মুজিবুর রহমানকে কঠোর নজরদারিতে রাখার জন্য ফরিদপুরের পুলিশকে নিম্নোক্ত নির্দেশ দেন : Please keep continuous on Sk. Mujibur Rahman and if he indulges again in prejudicial activities he should be arrested. তাছাড়া শেখ মুজিবুর রহমান যখন কিছুটা সুস্থ হয়ে ঢাকায় ফেরেন তখনও তাঁর উপর কঠোর পুলিশী এবং গোয়েন্দা নজরদারি চালানো হয়। ১৮ এপ্রিল, ১৯৫২ তারিখের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয় : It appears from a report of D. I. O. (Gopalganj) that Sk. Mujibar Rahman (AML-Ex-Security Prisoner) S/O Lutfar Rahman of Tungipara, Gopalganj, faridpur was to start for Dacca on 16.4.52. Arrangements were however made to shadow him up to dacca. ফলে বদরুদ্দীন উমর, অলি আহাদ এবং মোহাম্মদ তোয়াহাসহ অন্যরা শেখ মুজিবের মুক্তিদান প্রসঙ্গে তাঁর ভাষা-আন্দোলনে সম্পৃক্ততা না থাকা বিষয়ে যে কল্পকাহিনি ফেঁদেছেন, তা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। কাজেই ঐ সময় শেখ মুজিবের মুক্তিদান-প্রসঙ্গ তুলে তাঁরা তাঁর ভাষা-আন্দোলনে সম্পৃক্ততা অস্বীকার করার যে সবক দিয়েছেন, তা ধোপে টেকে না।

সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, ৩১ মার্চ ১৯৫২সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, ৩১ মার্চ ১৯৫২

চতুর্থত : তাঁরা বলার চেষ্টা করেছেন, ফরিদপুর কারাগারে থাকা অবস্থায় এবং কারামুক্ত হয়ে শেখ মুজিব ভাষা-আন্দোলন সম্পর্কে নীরব ছিলেন। তাঁদের এ ধরনের ভাবনাও যথার্থ নয়। কারণ সমসাময়িক পত্রপত্রিকা, শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং আনিসুজ্জামানের স্মৃতিকথা ‘কাল নিরবধি’ থেকে জানা যায়, ঢাকায় গুলিচালনা ও ধরপাকড়ের সংবাদ শুনে শেখ মুজিবুর রহমান অতিশয় মর্মাহত হন, তাঁদের অনশনের দাবির সঙ্গে একুশের গুলিচালনার ঘটনার প্রতিবাদ যুক্ত করেন এবং মুক্ত হয়ে শহিদদের শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন একুশের গুলিচালনার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। একইসঙ্গে তিনি দ্রুত ঢাকায় ফিরে আসার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। ১৯৫২ সালের ৫ই মার্চ এবং ৩১ মার্চ ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়। বাস্তবেই কিছুটা সুস্থ হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় ফিরে আসেন এবং বিভিন্ন সভা-সমাবেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেন ও কারাবন্দিদের মুক্তির দাবি করেন। তিনি করাচী গিয়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বন্দিদের মুক্তির দাবি জানান এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে দিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে বিবৃতি প্রদান করান। সেখানে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদদের ভাষা-আন্দোলন সম্পর্কে বিভ্রান্তি দূর করেন।

পঞ্চমত : আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক ১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত সম্মেলনে শেখ মুজিব প্রদত্ত বক্তব্য খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করে লিখেছেন : ‘দুই মাস পর নতুন করে গঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভায় শেখ সাহেবের বক্তৃতা থেকেও এই ঘটনা (ভাষা-আন্দোলনে সম্পৃক্ততা না থাকা) সঠিক বলে মনে হয়।’ তাঁরা শেখ মুজিবের ভাষণের যে অংশটুকু দৈনিক আজাদ পত্রিকার সংবাদ থেকে তুলে ধরেছেন, তা হলো : ‘দীর্ঘ আড়াই বছর কারাবাসের পর আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা যখন ভাষা সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, আমি তখন কারাগারে অনশনরত।’ বস্তুতপক্ষে, শেখ মুজিব ঐ সম্মেলনে এর বাইরে আরও অনেক কথা বলেছিলেন, যা ইত্তেফাক, আজাদ, সৈনিকসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি ভাষা-আন্দোলনকে জনগণের ন্যায্য দাবি বলে অভিহিত করেন। আজাদ পত্রিকায় তাঁর বক্তৃতার বাকী অংশে যা বলা হয়েছে, তা হলো : ‘আপনারা সংঘবদ্ধ হোন, মুসলিম লীগের মুখোশ খুলে ফেলুন। এই মুসলিম লীগের অনুগ্রাহে মওলানা ভাসানী, অন্ধ আবুল হাশেম ও অন্যান্য কর্মীরা আজ কারাগারে। আমরা বিশৃঙ্খলা চাই না, বাঁচতে চাই, লেখাপড়া করতে চাই; ভাষা চাই’। তিনি রাষ্ট্রভাষার উপর গণভোট দাবি করে বলেন, ‘মুসলিম লীগ সরকার আর মর্নিং নিউজ গোষ্ঠী ছাড়া প্রত্যেকেই বাংলা ভাষা চায়।’ এদিনের বক্তৃতায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়ে বিবৃতি প্রদানের বিষয়টিকে তিনি কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন। কাজেই, ‘আপনারা যখন ভাষা সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, আমি তখন কারাগারে অনশনরত’, এ উক্তি থেকেই বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে শেখ মুজিবের অবদান খারিজ করে দেওয়া যায় না। ইতিহাসের সত্য হলো, শেখ মুজিবুর রহমান ’৫২-র ভাষা-আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত না থাকলেও কারাগারে বসে ছাত্রনেতাদের নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে এ আন্দোলনকে সফল করে তুলেছেন, যা ছাত্রনেতাদের বক্তব্য ও আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি থেকে প্রমাণ করা যায়। তিনি সরকারের জন্য কতটা আতঙ্কের ছিলেন, তা তাঁর উপর পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কঠোর নজরদারি থেকেই উপলব্ধি করা যায়।

ষষ্ঠত : জেলখানা থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক চিরকুট পাঠিয়ে নির্দেশনা প্রদানের বিষয়টিকে বদরুদ্দীন প্রথম দিকে পরোক্ষভাবে মেনে নিলেও, পরবর্তীকালে বিভিন্ন লেখায় তা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন : ‘যিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পায়খানার গবাক্ষ থেকে ভাষা আন্দোলন পরিচালনা করছিলেন তাঁকে কীভাবে সেই সংকটজনক সময়ে সরকার মুক্তি প্রদান করলো? এই রাজনৈতিক মারফতী বা অধ্যাত্মবাদের মহিমা বোঝা আমাদের মতো ক্ষুদ্র বুদ্ধিসম্পন্ন লোকদের কর্ম নয়।’ (দেশ, কলকাতা : ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮) বদরুদ্দীন উমরের এ মন্তব্য বালখিল্যপনা বৈ আর কিছু নয়। যেখানে ভাষা-আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতৃবৃন্দ, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ বলেছেন ভাষা-আন্দোলনের সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান, কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদসহ অনেক ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজে সাক্ষাৎ করেছেন এবং আন্দোলনে নির্দেশনা দিয়েছেন; সেখানে বদরুদ্দীন উমর স্বভাবসুলভ ভাষায় যে উক্তি করেছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে জেলখানা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ছাত্রনেতাদের নির্দেশনা প্রদানের বিষয়ে বদরুদ্দীন উমরের প্রত্যেকটি মত বিভিন্ন যুক্তি দ্বারা খণ্ডন করে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন : ‘উমরকে বাহবা না দিয়ে পারা যায় না। বায়ান্ন সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ধারেকাছেও তিনি ছিলেন না। … একটি আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থাকলে পদে পদে যে ভুল হয়, ১৪৪ ধারা সম্পর্কে উমরের বালখিল্য উক্তিই তার প্রমাণ।’ অলি আহাদ লিখেছেন : ‘শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারী হইতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিলেন। চিকিৎসার কারণে সরকার তাঁহাকে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করেন। প্রহরী পুলিশের ইচ্ছাকৃত নির্লিপ্ততার সুযোগ গ্রহণ করিয়া আমরা তাঁহার সহিত হাসপাতালেই কয়েক দফা দেখা করি। তিনি ও নিরাপত্তা বন্দী মহিউদ্দিন আহমদ ১৬ই ফেব্রুয়ারী হইতে মুক্তির দাবীতে অনশন ধর্মঘট করিবেন, সেই কথা শেখ সাহেবই আমাদিগকে জানাইয়াছিলেন। … ১৫ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে শেখ মুজিবর রহমানকে ফরিদপুর জেলা কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয় এবং এই ১৫ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে ফরিদপুর যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে নারায়ণগঞ্জ নেতৃবৃন্দের সহিত শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎ ঘটে।’ (জাতীয় রাজনীতি : ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, পৃ. ১৩৬-১৩৭)

এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, অলি আহাদ, আবদুল মতিন, আহমদ রফিক, বদরুদ্দীন উমরসহ যাঁরা ভাষা-আন্দোলনে শেখ মুজিবের অবদানকে অস্বীকার করতে চেয়েছেন, তাঁদের বক্তব্য ইতিহাসের কষ্টিপাথরে যাচাই করলে যুক্তিগ্রাহ্য ও যথাযথ ঐতিহাসিক সত্য বলে মনে হয় না।

মোহাম্মদ তোয়াহা ও মোহাম্মদ সুলতানের বক্তব্য যাচাই

রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে যাঁরা অস্বীকার করেছেন, তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে উচ্চারণ করতে হয় মোহাম্মদ তোয়াহার নাম, যাঁকে ‘ঢাকার উত্তপ্ত রাজপথে ২১ ফেব্রুয়ারির রাত হতে আর দেখা যায় নাই’। ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্ব করা প্রসঙ্গে মোহাম্মদ তোয়াহা যে বক্তব্য তুলে ধরেছেন, সে প্রসঙ্গে আগেই আলোকপাত করা হয়েছে। এবার তাঁর অন্য বক্তব্যগুলো পর্যালোচনা যাক। মোহাম্মদ তোয়াহা বলেছেন : ‘এর (১৬ মার্চ আমতলার সভা) পূর্বে নাজিমুদ্দীনের সাথে আমাদের একটা agreement হয়েছিলো, কিন্তু মুজিব সে এর কোনো কথা জানতো না।’ মোহাম্মদ তোয়াহার এ বক্তব্য ঠিক নয়, কারণ ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দের যে ৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিলো, তার খসড়া কারাগারে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য নেতৃবৃন্দকে দেখিয়ে তাঁদের অনুমোদন নেওয়া হয়। মোহাম্মদ তোয়াহা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষা-আন্দোলনে অবদান নিয়ে আরেকটি আষাঢ়ে গল্প সৃষ্টি করেছেন, তা হলো : ‘একদিন আমি এবং তাজউদ্দীন আইন পরিষদের সদস্য মোঃ তোফাজ্জল আলীর বাসায় যাই। তিনি আমাদের দেখেই দূর থেকে চীৎকার করে বলে উঠলেন—‘আরে এসো, এসো, তোমাদের খবর আছে।’ আমরা বুঝতে পারলাম না। এ ‘খবর আছে’ কথার অর্থ কি? আমরা গিয়েছিলাম প্রাদেশিক পরিষদ থেকে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট যে সুপারিশ পাঠানোর কথা ছিল, সে বিষয়ে জানার জন্য। সে বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করলে তিনি যেন হেলা করেই বললেন, ‘আরে, ওসব হয়ে যাবে। এখন কথা শুনো, Perhaps you are getting two ministers and one Ambassador. মুজিব তোমাদের কিছু বলেনি।’ আমরা অবাক হয়ে গেলাম। তোফাজ্জল আলী সাহেবের সাথে আরো কিছুক্ষণ আলাপ হলো। আলাপের পর আমাদের বুঝতে বাকি রইল না যে, শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনের প্রাণশক্তিকে MLA-দের পদ এবং ক্ষমতা লাভের সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করছেন। … তখন আইন পরিষদের ভিতরে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সমর্থক MLA-দের একটি গ্রুপ ছিল। এঁদের মধ্যে ছিলেন মোঃ তোফাজ্জল আলী (কুমিল্লা), মফিজ উদ্দীন (কুমিল্লা), আনোয়ারা বেগম, খান সাহেব ওসমান আলী (নারায়ণগঞ্জ), মোহাম্মদ আলী (বগুড়া প্রমুখ)। শেখ মুজিব এঁদের কাছে আনাগোনা করতেন এবং প্রচার করে বেড়াতেন যে, ইউনিভার্সিটিতে যেসব আন্দোলন হচ্ছে তা তিনি এবং তাঁর সমর্থকেরাই পরিচালনা করছেন। সুতরাং, তাঁদের মধ্য থেকে (সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ থেকে) যদি মন্ত্রিত্বে না নেয়া হয় তবে যে কোন মূল্যে আন্দোলন দ্বারা নাজিমুদ্দীন সরকারকে উৎখাত করা হবে। এইভাবে শেখ মুজিব-সোহরাওয়ার্দী বনাম নাজিমুদ্দীন-নূরুল আমীনের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে মহান ভাষা আন্দোলনের উত্তাল জোয়ারকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। ভাষা আন্দোলনকে উপদলীয় সংকীর্ণ স্বার্থে রাজনৈতিকভাবে চিত্রিত করার মাঝেই শেখ মুজিবের প্রকৃত ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যায়। (উদ্ধৃত, মোস্তফা কামাল, ভাষা আন্দোলন : সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন, পৃ. ৬০-৬১)

আহত শওকত আলীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু। অনেকে ছবিটিকে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের বলে উল্লেখ করে থাকেন। বাস্তবে ছবিটি ১৬ মার্চ বা তার পরের। কারণ শওকত আলী ১১ মার্চ আহত হননি, আহত হন ১৬ মার্চ।আহত শওকত আলীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু। অনেকে ছবিটিকে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের বলে উল্লেখ করে থাকেন। বাস্তবে ছবিটি ১৬ মার্চ বা তার পরের। কারণ শওকত আলী ১১ মার্চ আহত হননি, আহত হন ১৬ মার্চ।

মোহাম্মদ তোয়াহার এ বক্তব্য যে কতটা অযৌক্তিক এবং অসংলগ্ন তা তাঁর নিজের কথাতেই খুঁজে পাওয়া যায়। একই সাক্ষাৎকারে কখনো তিনি বলছেন, ঢাকার ছাত্রসমাজে শেখ মুজিবের ‘পরিচিতি ছিল তখন নিতান্ত নগণ্য’, কখনো বলছেন, ভাষা-আন্দোলনে ব্যবহার করে শেখ মুজিব ‘নাজিমুদ্দীন সরকারকে উৎখাত’ করার চেষ্টা করেছে। ‘নিতান্ত নগণ্য’ (?) পরিচিত মানুষ নাজিমুদ্দীন সরকারকে উৎখাত করবে! কথাটি স্ববিরোধী নয় কি? হ্যাঁ, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তোফাজ্জল হোসেনের যোগাযোগ ছিল, তোফাজ্জল হোসেন এবং তাঁর দলের লোকেরা ভাষা-আন্দোলনের সুযোগে নাজিমুদ্দীনকে বেকায়দায় ফেলার কৌশল খুঁজতে পারেন, তার মানে এই নয় যে, ‘ভাষা আন্দোলনকে উপদলীয় সংকীর্ণ স্বার্থে রাজনৈতিকভাবে চিত্রিত করার মাঝেই শেখ মুজিবের প্রকৃত ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যায়।’ মোহাম্মদ তোয়াহার এ অভিমত মনগড়া। কারণ তাজউদ্দীন আহমদ বা অন্য কেউই এ কথা বলেননি। তাছাড়া শেখ মুজিবুর রহমান তোফাজ্জল আলীদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের সঙ্গে যে ছিলেন না, তা তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে উল্লিখিত বিবরণ থেকেই জানা যায়। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল প্রকার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ অঞ্চলের মানুষ যে ধরনের পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই পাকিস্তান কায়েমের জন্য ঐ সময় শেখ মুজিব দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন। তিনি লিখেছেন : ‘ভাষা আন্দোলনের পূর্বে মোহাম্মদ আলী, তোফাজ্জল আলী এবং ডা. মালেক সাহেবের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ এমএলএদের মধ্যে এক গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছিল। … প্রায়ই তোফাজ্জল আলী সাহেবের বাড়িতে এদের সভা হতো। দেখা গিয়েছিল, এদের সমর্থক সংখ্যা এমন পর্যায়ে এসে পড়েছে যে, ইচ্ছা করলে নাজিমুদ্দীন সাহেবের বিরুদ্ধে অনাস্থা দিলে পাস হয়ে যেতে পারে। … এদিকে জিন্নাহ সাহেব মোহাম্মদ আলী সাহেবকে ডেকে এক ধমক দিলেন, দল সৃষ্টি করার জন্য। আর বললেন, রাষ্ট্রদূত হয়ে বার্মায় যেতে। … কিছুদিন পর ডা. মালেকও মন্ত্রিত্ব পাবেন বলে ঠিক হল। শেষ পর্যন্ত তোফাজ্জল আলী সাহেব বাকি ছিলেন। তিনি একদিন আমাকে বললেন, “মুজিব দেখলে তো, মোহাম্মদ আলী সাহেব চলে গেলেন, ডা. মালেকও মন্ত্রী হয়ে যাচ্ছে, আমাকেও ডেকেছে মন্ত্রিত্ব নিতে। কি করি বল তো? একলা তো আর বাইরে থেকে কিছু করা যাবে না। তোমার মত আমার নেওয়া দরকার।” … আমি তাঁকে বললাম, ‘তবুও তো আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর কেউ তো জিজ্ঞাসা করল না। কি আর আপনি একলা করতে পারবেন, মন্ত্রিত্ব নিয়ে নেন, আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। যে আদর্শ ও পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করেছি, সে আদর্শ কায়েম না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালাব।’

বঙ্গবন্ধু যদি ভাষা-আন্দোলনকে উপদলীয় সঙ্কীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করতেন, তাহলে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার কথা বলতেন না, সরকারের অংশীদার হয়ে তোফাজ্জল আলীদের মতোই নিশ্চুপ হয়ে যেতেন। তাছাড়া হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর গ্রুপের নেতাদের নাজিমুদ্দীনবিরোধী চক্রান্তকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেননি। সোহরাওয়ার্দীর শীষ্য হিসেবে শেখ মুজিবও তাই এই চক্রান্তে যুক্ত হননি। ১১ মার্চ এবং ১৬ মার্চের ভাষা-আন্দোলন কর্মসূচিতে তাঁর যে ভূমিকা, তাতে কোনো চক্রান্তে যুক্ত থাকা বা কারো স্বার্থ উদ্ধারের ব্যাপার ছিল না। এটা ছিল মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। কাজেই তোফাজ্জল আলী প্রমুখের সঙ্গে শেখ মুজিবকে জড়িয়ে মোহাম্মদ তোয়াহা যা বলেছেন, তা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শনে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের কোনো ঠাঁই ছিল না, আর সে কারণেই তিনি সরকারের নানা জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন, বছরের পর বছর জেলের প্রকোষ্ঠে জীবন কাটিয়েছেন।

মোহাম্মদ তোয়াহা ১৯৪৮ সালের ভাষা-আন্দোলনের মতো ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে শেখ মুজিবের অবদানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে গিয়ে যা বলেছেন, তাও পর্যালোচনার দাবি রাখে। মোহাম্মদ তোয়াহা বলেছেন : ‘ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের তেমন কোন অবদান ছিল না। এ সম্পর্কে অনেক ডাহা মিথ্যাচার প্রচলিত আছে, যা ভাষা আন্দোলনের মহান ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। আর তখন শেখ মুজিবের অবদান থাকার কথাও নয়। কারণ ঢাকার ছাত্র সমাজে তাঁর পরিচিতি ছিল নিতান্ত নগণ্য। কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে যেসব ছাত্ররা stray ঘোরাফেরা করতো শেখ মুজিব ছিলেন সে ছাত্র গ্রুপেরই একজন। … ভাষা আন্দোলনকে উপদলীয় সংকীর্ণ স্বার্থে রাজনৈতিকভাবে চিত্রিত করার মাঝেই শেখ মুজিবের প্রকৃত ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যাবে। (উদ্ধৃত, মোস্তফা কামাল, ভাষা আন্দোলন : সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন, পৃ. ৬০)

মোহাম্মদ তোয়াহা বাংলা একাডেমির একুশের স্মৃতিচারণ ’৮০ গ্রন্থে তিনি আরও রূঢ় ভাষায় তাঁর স্বভাবসুলভ মুজিব-বিদ্বেষী স্টাইলে লিখেছেন : ‘১৯৭৩ সালে শেখ মুজিব যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান তখন কে. জি. মুস্তাফা টেলিভিশনে … বলেছিলেন যে ভাষা আন্দোলনের মূল ব্যক্তি ছিলেন শেখ মুজিব। কোথায় হাসপাতালে তিনি অসুস্থ হলেন, কোথায় পায়খানার ভিতরে আই. বি’র চোখে ধুলো দিয়ে ঢুকলেন ইত্যাদি কথা। এসব ভাষণ সত্য নয়। ১৯৪৮ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের উত্তেজিত করে পুলিশের লাঠিপেটা খাওয়ানো ছাড়া শেখ মুজিবের ভাষা আন্দোলনে আর কোন ভূমিকা ছিল না।’ (একুশের স্মৃতিচারণ ’৮০, বাংলা একাডেমি, ঢাকা : ১৯৮০; পৃ. ৯৮) মোহাম্মদ তোয়াহার কথাগুলো ইতিহাসের সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা বৈ আর কিছু নয়। একে একে তাঁর বক্তব্য খণ্ডন করা যায় এভাবে :

প্রথমত : মোহাম্মদ তোয়াহা ঢালাওভাবে বলেছেন, ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর তেমন কোন অবদান ছিল না; কিন্তু ইতিহাস তা বলে না। ভাষা-অন্দোলনের শুরু অর্থাৎ ১৯৪৮ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধু সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ভাষা-আন্দোলনের পক্ষে পুস্তিকা প্রকাশ, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি পুনর্গঠন, ১১ মার্চের কর্মসূচি প্রণয়ন, জেলায় জেলায় এ কর্মসূচির পক্ষে জনমত গঠন, ১০ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে পরিকল্পনা গ্রহণ, ১১ মার্চ পিকেটিংয়ে অংশগ্রহণ এবং পুলিশি হামলার শিকার ও কারাভোগ, কারাগার থেকে নাজিমুদ্দীনের চুক্তি সমর্থন, ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশে সভাপতিত্ব করা ও মিছিল নিয়ে পরিষদ ভবন ঘেরাও করা, ১৭ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলের সভায় বক্তৃতা দান, জিন্নাহর রেসকোর্স ময়দানের বক্তৃতার প্রতিবাদ; এসব ঘটনা প্রমাণ করে ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান সম্পর্কে মোহাম্মদ তোয়াহার বক্তব্য ভিত্তিহীন এবং সুস্পষ্ট ইতিহাস-বিকৃতি।

দ্বিতীয়ত : ঢাকার ছাত্রসমাজে শেখ মুজিবের পরিচিতি নিতান্ত নগণ্য বলে মোহাম্মদ তোয়াহা যে উক্তি করেছেন, তাও বস্তুনিষ্ঠ নয়। কারণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প দিনের মাথায় গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠা এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালনসহ এসব সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে শেখ মুজিবের সরাসরি সম্পৃক্ততা থেকে প্রমাণ হয় ঢাকার ছাত্রসমাজে তাঁর পরিচিতি নিতান্ত নগণ্য ছিল না। আর বায়ান্নর ভাষা-অন্দোলনের সময় তো শেখ মুজিব জাতীয় নেতায় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন, তখন তিনি ছিলেন প্রধান বিরোধী দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম-সম্পাদক। ২১ ফেব্রুয়ারির মূল কর্মসূচির সঙ্গে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিটি যুক্ত করা হয়েছিল তখনকার রাজনীতিতে তাঁর বলিষ্ঠ অবস্থানের কারণেই।

তৃতীয়ত : ভাষা-আন্দোলনকে শেখ মুজিব উপদলীয় সঙ্কীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করেছেন বলে মোহাম্মদ তোয়াহা যে আষাঢ়ে গল্প ফেঁদেছেন, তাও যুক্তিগ্রাহ্য নয়। কারণ ভাষা-আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অংশগ্রহণ এবং একুশের চেতনা লালন ও বাস্তবায়নে তাঁর যে ভূমিকা তাকে কোনো অবস্থাতেই উপদলীয় সঙ্কীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার বলে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।

চতুর্থত : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ভাষা-আন্দোলনে ছাত্রনেতাদের নির্দেশদান প্রসঙ্গে তোয়াহা যে উক্তি করেছেন, তা শিষ্টাচারবর্জিত, যুক্তিহীন এবং বাস্তবতাবর্জিত। তিনি বলেছেন, ‘কোথায় হাসপাতালে তিনি অসুস্থ হলেন, কোথায় পায়খানার ভিতরে আই. বি’র চোখে ধুলো দিয়ে ঢুকলেন ইত্যাদি কথা। এসব ভাষণ সত্য নয়।’ কারাগার থেকে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং ভাষা-আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদন; অলি আহাদ, গাজীউল হক, জিল্লুর রহমান, কামরুজ্জামান প্রমুখের স্মৃতিচারণ এবং বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’র বিবরণে। যা থেকে মোহাম্মদ তোয়াহার এ বক্তব্য একেবারেই ভিত্তিহীন ও হাস্যকর বলে মনে হয়।

পঞ্চমত : মোহাম্মদ তোয়াহা বলেছেন, ‘১৯৪৮ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের উত্তেজিত করে পুলিশের লাঠিপেটা খাওয়ানো ছাড়া শেখ মুজিবের ভাষা আন্দোলনে আর কোন ভূমিকা ছিল না।’ তাঁর এ ধরনের উক্তির পর এ বিষয়ে কথা বলাই অনর্থক, কারণ তোয়াহা কথিত ১৯৪৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি থাকলেও ঐদিন ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ হয়নি।

কাজেই ভাষা-আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভূমিকা সম্পর্কে মোহাম্মদ তোয়াহা যা বলেছেন, তা বস্তুনিষ্ঠ নয়; পুরোটাই যুক্তিহীন, তথ্যের বিকৃতিতে ভরা; যা ভাষা-আন্দালনের ইতিহাস-বিকৃতিরই নামান্তর। ফলে এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের বক্তব্য উদ্ধৃত করে আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, ‘তোয়াহা শেখ মুজিবের বিরোধী ছিলেন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত।’ তাই ভাষা-আন্দোলনে তাঁর অবদানকে খাটো করার অপচেষ্টা থেকে তিনি এ বিষয়ে বিভ্রান্তিকর ও লাগামহীন মন্তব্য করেছেন, যা আরও ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করেছেন বদরুদ্দীন উমর ও তাঁর অনুসারীরা। মোহাম্মদ তোয়াহার এসব মন্তব্য ঈর্ষাপ্রসূত, রাজনীতিতে শেখ মুজিবের ধারে-কাছেও থাকতে না পারার ক্ষোভ থেকে উদ্ভূত এবং নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টার প্রয়াস থেকে উৎসারিত।

একই কথা বলা যায়, মোহাম্মদ সুলতানের বক্তব্য ও বিবরণ প্রসঙ্গেও। মোহাম্মদ সুলতান বলেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সাথে শেখ মুজিবের কোন সম্পর্ক নেই।’ এর বিপরীতে অনেক যুক্তি এবং প্রামাণ্য তথ্য এ প্রবন্ধে হাজির করা হয়েছে। এখানে আমরা শুধু একটি প্রমাণ তুলে ধরবো তা হলো, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সাথে শেখ মুজিবের যদি কোনো সম্পর্ক না-ই থাকবে তবে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিতে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি সংযুক্ত করা হলো কেন? তাছাড়া মোহাম্মদ সুলতানের বক্তব্য গতানুগতিক, ঐ মোহাম্মদ তোয়াহার বক্তব্যেও মতোই, এর পক্ষে কোনো যুক্তি বা তথ্য-প্রমাণ নেই। ১৯৭৪ সালে কে. জি. মুস্তাফার সঙ্গে শেখ মুজিবের এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ টেনে তিনি ঢালাওভাবে এ মন্তব্য করেছিলেন।

 

গাজীউল হকের স্ববিরোধিতা

আটচল্লিশের ভাষা-আন্দোলনে শেখ মুজিবের অবদান সম্পর্কে যথাযথ মূল্যায়ন করলেও বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে তাঁর অবদান বিষয়ে গাজীউল হক একেক সময় একেক ধরনের কথা বলেছেন। কখনো তাঁর অবদানকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন, আবার কখনো প্রায় সকল কৃতিত্ব তাঁকে দিয়েছেন। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন গ্রন্থের (ফাল্গুন, ১৩৯১) ‘একুশের স্মৃতিচারণ’ শীর্ষক লেখায় তিনি এ ভাষা-আন্দোলনে শেখ মুজিবের অবদান সম্পর্কে লিখেতে গিয়ে এক ধরনের ধুম্রজাল সৃষ্টি করেছেন। ঐ স্মৃতিচারণে কারাগার থেকে শেখ মুজিবের ভাষা-আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা প্রদানের বিষয়টিকে তিনি ‘বানোয়াট গল্প’ বলে উড়িয়ে দিয়ে লিখেছেন : ‘এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, স্বাধীনতা উত্তরকালে টেলিভিশনে দুটো সাক্ষাৎকারে এ কথাটি প্রমাণ করা চেষ্টা করা হয়েছিল যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশেই নাকি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়েছিল এবং এটিও বলা হয়েছিলো যে, ২০ ফেব্রুয়ারীর রাতে বঙ্গবন্ধু নাকি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোনও এক জানালা দিয়ে এ নির্দেশ দেন। কথাটি আদৌ সত্য নয়। কারণ ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখেই অনশনরত বন্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। ২০শে ফেব্রুয়ারি তারিখে বিকেল ৩টার দিকে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়। তখন জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেলে। সুতরাং ঢাকা মেডিকেল কলেজের হাসপাতালের কোনও বাথরুমের গবাক্ষ পথে শেখ মুজিবুর রহমান ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার নির্দেশ দিলেন—এটি বানোয়াট গল্প। (‘একুশের স্মৃতিচারণ’, বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, পৃ. ৫৯)

গাজীউল হকের এ বক্তব্যে তথ্যবিভ্রাট আছে। তিনি বঙ্গবন্ধুকে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তরিত করার তারিখ উল্লেখ করেছেন ১৮ ফেব্রুয়ারি। তাঁর এ তথ্য ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে তারিখটি ছিল ১৫ ফেব্রুয়ারি। তাছাড়া ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে শেখ মুজিবুর রহমানের ১৪৪ ধারা ভঙ্গের নির্দেশের কথা কেউ বলেননি। ছাত্রলীগ নেতারা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখা করেছেন ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে এবং ফেব্রুয়ারি মাসের একেবারে শুরুতে, খাজা নাজিমুদ্দীনের পল্টন ময়দানে বক্তৃতার অব্যবহিত পরে এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জে। ‘একুশের স্মৃতিচারণ’ শীর্ষক লেখায় বিভ্রান্তিকর কথা বলে ধূম্রজাল সৃষ্টি করলেও গাজীউল হক পরবর্তীকালে ‘ভালোবাসি মাতৃভাষা’ গ্রন্থের (২০০২) ‘‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’’ শীর্ষক লেখায় মত পরিবর্তন করেন। এ লেখায় বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকার পক্ষে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরে তিনি লেখেন : ‘মুজিব তখন কারাগারে। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মিছিল ধর্মঘট হয়েছিল। মিছিল করে সারা ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করেছিল শত সহস্র ছাত্র-জনতা। মিছিল শেষে বেলতলায় জমা হয়েছে সবাই পরবর্তী ঘোষণার জন্যে। শামসুল হক চৌধুরী, গোলাম মওলা, আব্দুস সামাদ আজাদের মাধ্যমে সংবাদ পাঠিয়েছেন শেখ মুজিব—খবর পাঠিয়েছেন তিনি, সমর্থন জানিয়েছেন একুশের দেশব্যাপী হরতালের প্রতি। একটি বাড়তি উপদেশ—মিছিল করে সেদিন আইনসভা ঘেরাও করতে হবে, বাংলা ভাষার প্রতি সমর্থন জানিয়ে আইনসভার সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হবে। আরও একটি খবর পাঠিয়েছেন যে, তিনি এবং মহিউদ্দিন সাহেব রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে অনশন করবেন। একুশে ফেব্রুয়ারি হরতাল হবে।’

রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু : ঐতিহাসিক সত্য

রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে অনেকে খণ্ডিত ও বিকৃতভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করলেও এ আন্দোলনের ঘটনা-পরম্পরা ও এতে তাঁর সম্পৃক্ততা থেকে প্রমাণিত হয় এসব অপচেষ্টা দ্বারা ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলার সুযোগ নেই। আটচল্লিশের ভাষা-আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে কারাগার থেকে নির্দেশনা দিয়েছেন। এ আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ ও তাঁর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষে সম্পৃক্ততা থেকেই এ কথা বলা যায়। কারাগার থেকে তিনি বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে কীভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা জানা যায় ঐ সময়কার অনেক ছাত্রনেতা ও ভাষাসংগ্রামীর স্মৃতিচারণ, গোয়েন্দা প্রতিবেদন, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, দলিলপত্র, শেখ মুজিবের নিজের লেখা বিবরণ প্রভৃত সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে। বঙ্গবন্ধুর কারাসঙ্গী মহিউদ্দীন আহমেদ, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা মোঃ মানিক সিকদার প্রমুখও শেখ মুজিবের সঙ্গে ছাত্রতোদের সাক্ষাৎকার ভাষা-আন্দোলন বিষয়ে নির্দেশনা প্রদানের কথা বলেছেন। ৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি ১০ জন ১০ জন করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তাবকারী ভাষাসংগ্রামী ও ছাত্রনেতা আব্দুস সামাদ আজাদ শেখ মুজিবের ভাষা-আন্দোলনে নির্দেশনা প্রদান প্রসঙ্গে লিখেছেন : ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে এ বছরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবারও গ্রেফতার হন এবং সেই সময় তিনি একাধারে প্রায় আড়াই বছর কারাবরণ করেন। প্রতি ১৫ দিন অন্তর অন্তর তাঁকে (বঙ্গবন্ধুর) আদালতে আনা হতো এবং সেই সুবাদে আমিসহ অনেকেই বিভিন্নভাবে তাঁর সাথে দেখা করতাম। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। আমি ও তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজসহ আমরা অনেকেই বিভিন্ন সময় গোপনে তাঁর সাথে হাসপাতালে সাক্ষাৎ করতাম এবং ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পারামর্শ নিতাম।’ (‘ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিকথা ও পটভূমি’, ভালোবাসি মাতৃভাষা, পৃ. ১১৩)

২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ : ভাষা শহিদদের স্মরণে মোনাজাত ও শোভাযাত্রার অগ্রভাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ : ভাষা শহিদদের স্মরণে মোনাজাত ও শোভাযাত্রার অগ্রভাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।

নিরাপত্তাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখা হয়েছিলো তখনকার মেডিকেল কলেজের শেষবর্ষের ছাত্র মির্জা মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বঙ্গবন্ধুর পূর্বপরিচিত ছিলেন তাই হাসপাতালে একাধিকবার তাঁর চিকিৎসার খোঁজ-খবর নেন। ঐ সময়কার ঘটনার স্মৃতিচারণ করে তিনি লিখেছেন : ‘১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু নিরাপত্তা বন্দী অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আমি তখন এই কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র। দোতলায় ৮ নম্বর ওয়ার্ড-সংলগ্ন একটি কেবিনে তিনি থাকেন। আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করলাম। রাউন্ড দেয়ার সময় প্রফেসরদের সঙ্গে আমরা যেতাম কিন্তু আমাদেরকে কেবিনে প্রবেশ করতে দিত না। আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না, তবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পূর্ব সম্পর্ক ছিল। কলকাতায় আমাদের মাঝে প্রথম পরিচয় হয়, পরে ঢাকা এসেও বহু বার দেখা হয়েছে। একদিন বঙ্গবন্ধু ‘এই মির্জা’ বলে আমাকে ডেকে তাঁর কেবিনের জানালার কাছে নিয়ে যান এবং ভাষা আন্দোলনের খোঁজখবর নেন। তিনি আমাকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন।’ (সাক্ষাৎকার; উদ্ধৃত, এম আর মাহবুব, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পৃ. ৮৪)

ঐ সময়ের ঘটনাপ্রবাহ এবং ছাত্রনেতাদের তৎপরতা থেকে প্রমাণ হয় ‘ছাত্রনেতারা গোপনে তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) সাথে দেখা করতেন। তাঁর মুক্তির জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিবৃতি দেন। হাসপাতালে বসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার কারণে শেখ মুজিবকে চিকিৎসা শেষ না হতেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফেরত নেওয়া হয় এবং দ্রুত ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। কারাগারে থাকাকালে তিনি ও মহিউদ্দীন আহমেদ চিঠি দিয়ে সরকারকে জানান, ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মুক্তি না দিলে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তাঁরা অনশন ধর্মঘট শুরু করবেন।’

একটি কথা উল্লেখ করা দরকার, পক্ষ-বিপক্ষে যাঁরা লিখেছেন বা স্মৃতিচারণ করেছেন, তাঁদের অনেকের লেখাতেই রয়েছেন অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ কার্জন হলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তৃতার প্রতিবাদ প্রসঙ্গে ড. মযহারুল ইসলামের বিবরণের কথা। বাস্তবে কার্জন হলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে শেখ মুজিব উপস্থিত ছিলেন না, তিনি ছিলেন হলের বাইরে। কিন্তু মযহারুল ইসলাম তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ গ্রন্থে লিখেছেন : “তিন দিন পরে ঢাকার কার্জন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে ভাষণদানকালে আবার সেই একই কথা তিনি (মুহম্মদ আলী জিন্নাহ) জোর দিয়ে ঘোষণা করলেন—এবার শুধু মুজিব নয় এবং আবদুল মতিনও নয়, হলের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত শুধু গর গর গর ধ্বনিতে জিন্নাহ সাহেবের কণ্ঠস্বর স্তিমিত হয়ে এসেছিল। … আর এই সমগ্র পরিস্থিতি সুপরিকল্পিতভাবে সংগঠিত করেছিলেন শেখ মুজিব।’ (পৃ. ১২৩)

প্রভাতফেরিতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যেরা।প্রভাতফেরিতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যেরা।এভাবে দেখা যায়, এক পক্ষ বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা পুরোপুরি খারিজ করে দিতে চেয়েছেন; অন্য পক্ষ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলে সকল কৃতিত্ব তাঁর কাঁধে তুলে দিয়ে বাহ্বা নিতে চেয়েছেন। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং তাঁর সম্পর্কে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনসমূহ প্রকাশের পর ভাষা-আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা কী ছিল, তা দিবালোকের মতো সত্য হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে বিদ্বেষ-বন্দনাকারীদের অভিমতগুলোর অতিরঞ্জিত অংশ অসার বলে প্রমাণিত হয়েছে। ভাষা-আন্দোলনে তিনি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন, এটা ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, বক্তৃতা-বিবৃতি ও সমকালীন পত্রপত্রিকার সংবাদ পর্যালোচনা করলেই প্রমাণিত হয়।

রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন (বিশেষ করে অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, মোহাম্মদ সুলতান, আবদুল মতিন, আহমদ রফিক, বদরুদ্দীন উমর প্রমুখ); তাঁরা পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ফেডারেশনের নেতা-কর্মীদের অবদানকে বড় করে দেখাতে চেয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ও এর নেতা-কর্মী তথা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আতাউর রহমান খান, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখের অবদানকে খাটো করে দেখেছেন। এক্ষেত্রে কখনো কখনো কাজ করেছে তাঁদের আদর্শিক সঙ্কীর্ণতা, ব্যক্তিগত ঈর্ষা ও হীনম্মন্যতা। বাস্তবতা হলো, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ পূর্বাপর বিশ্লেষণ করলে এতে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের ‘সর্বোতভাবে’ অংশগ্রহণ (১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্তে ভিন্নমত পোশন ব্যতীত) এবং এই আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা পালন, সমকালীন রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব; সবকিছু পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর উজ্জ্বল ভূমিকার বিষয়টি ঐতিহাসিক সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়।

রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান যেসব কারণে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে, তা হলো : ‘(ক) ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রতিবাদ দিবসেই (১৯৪৮, ১১ মার্চ) শেখ মুজিব মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে গ্রেফতার বরণ করেন। (খ) ১৫ মার্চ মুক্তিলাভের সঙ্গে সঙ্গে তিনি খাজা নাজিমুদ্দীনের স্বাক্ষর করা আট দফা চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেন এবং আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। (গ) বায়ান্নর আন্দোলনে জেলে বসে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের মতের বিরুদ্ধে ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ছাত্রলীগের সদস্য ও সমর্থকদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে থাকতে নির্দেশ দেন। (ঘ) তিনিই শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বাংলা ভাষার পক্ষে মত পরিবর্তনে বাধ্য করেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উপদেশে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা আন্দোলনবিমুখ ভূমিকা গ্রহণ করলে ভাষা আন্দোলনের সাফল্য লাভ দুরূহ হয়ে উঠত। (ঙ) তিনি কমিউনিস্ট কর্মী ও নেতাদের সরকারের বিশেষ দমননীতির কবল থেকে রক্ষা করার জন্য দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। (চ) বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন অব্যাহত রাখেন এবং নেতৃত্ব দেন। (ছ) বাংলায় রোমান হরফ প্রবর্তনের আইয়ুবি চক্রান্তের বিরুদ্ধে মুনীর চৌধুরীসহ বিমিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা যে আন্দোলন গড়ে তোলেন, তার প্রতি প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে একাত্মতা ঘোষণা করেন। (জ) আইয়ুব-মোনেম সরকারের রবীন্দ্র সঙ্গীতবিরোধী চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি আওয়ামী লীগের সভায় উদ্বোধনী সঙ্গীত হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন। (ঝ) স্বাধীনতার পর সংবিধানে বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বিধিবদ্ধ করেন। (ঞ) জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলায় সর্বপ্রথম ভাষণ দিয়ে বাংলাকে আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদায় উন্নীত করেন।’ (আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ‘একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি : কিছু কথা’, ভালোবাসি মাতৃভাষা, পৃ. ৬৫) ভাষা-আন্দোলনের ফলে তাঁর মধ্যে যে চেতনা জাগ্রত হয় এবং এর মাধ্যমে তিনি যে নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করেন, তা তাঁকে স্বাধিকার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানের শক্তি দান করে এবং তাঁকে অবতীর্ণ করে ইতিহাসের মহানায়কের ভূমিকায়।

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪। জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশনে ভাষণ দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু।২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪। জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশনে ভাষণ দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু।বস্তুত, ভাষা-আন্দোলনের মাধ্যমেই রাজনৈতিক মঞ্চে শেখ মুজিবুর রহমানের যে আবির্ভাব ঘটে, আলোচনা-সমালোচনা কিংবা অন্ধ-বিদ্বেষ দ্বারা তা যেমন খারিজ করা যায়নি, তেমনি অতি মাত্রায় স্তাবকতা করেও তার হেরফের ঘটানো সম্ভব হয়নি। ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে তাঁর যে ভূমিকা তা ইতিহাসের কষ্টিপাথরে যাচাই-বাছাই হয়ে হয়ে আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। তাই ভাষা-আন্দোলনে তাঁর অবদানকে যাঁরা ইতিহাসের ‘কল্পকাহিনী’ বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাদের সে প্রচেষ্টা যেমন ব্যর্থ হয়েছে; তেমনি অতি বন্দনা দ্বারা যাঁরা তাঁকে সকল কৃতিত্বেও ভাগীদার করতে চেয়েছেন তারাও ব্যর্থ হয়েছেন। ঐতিহাসিক সত্যের কাছে উভয় পক্ষের সকল দুরভিসন্ধি পরাভূত হয়েছে। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান ও ভূমিকা পর্যালোচনার সময় একটি বিষয় সবসময় স্মরণে রাখতে হবে, তা হলো—টুঙ্গিপাড়ার ‘খোকা’ শেখ মুজিব মাতৃজঠোর থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ বা ‘জাতির পিতা’ ছিলেন না; পাকিস্তান আন্দোলনে তাঁর যে ভূমিকা, ভাষা-আন্দোলনে ভূমিকা তা থেকে উজ্জ্বল; পঞ্চাশের দশকের রাজনীতি অপেক্ষা ষাটের দশকের রাজনীতির মাঠ ছিল তাঁর অধিক নিয়ন্ত্রণে; সর্বোপরি ৬৬-র ৬-দফাভিত্তিক আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন এবং ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন এ ভূখণ্ডের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। কাজেই তাঁর ভাষা-আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানের বিষয়টি বিচার করতে হবে ঐ সময়ের রাজনীতিতে তাঁর অবস্থান বিচারে। আর সে বিচারে তিনি যে ভাষা-আন্দোলনের সামনের সারির একজন নেতা ছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই; তা তাঁর ভূমিকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যখন যে রকমই থাকুক না কেন। তাঁকে ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস থেকে ছুড়ে ফেলা এবং এই আন্দোলনের নিয়ন্তা শক্তি হিসেবে সকল কৃতিত্ব তাঁর কাঁধে তুলে দেওয়া উভয়ই ইতিহাস-বিকৃতি। উভয় পক্ষের বিদ্বেষ-বন্দনা এবং অতিরঞ্জনের দিকগুলো ইতিহাসের সত্যের মানদণ্ডে যাচাই-বাছাই হয়ে ভাষা-আন্দোলনে শেখ মুজিবের প্রকৃত ভূমিকা আজ দিবালোকের মতো সত্য হয়ে উঠেছে। যতই একে ইতিহাসের ‘কল্পকাহিনী’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হোক-না-কেন, তাতে তার অবদান এতটুকু ম্লান হবে না।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *