শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:২৫ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :

মাদক আনতে অস্ত্র দিচ্ছে মিয়ানমার: নারীরাও প্রশিক্ষণ নিচ্ছে ক্যাম্পে

কক্সবাজার ৭১ ডেস্ক:
আশ্রয় ক্যাম্পে কিছু রোহিঙ্গা নারীও অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আরাকান বিদ্রোহী গ্রæপের ক্যাডাররা ওই নারীদের অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছে। পুরনো রোহিঙ্গা তথা বাংলাদেশের জাতীয় সনদ হাতিয়ে নিয়ে বাংলাদেশী দাবিদার জঙ্গীরা রোহিঙ্গা নারীদের অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষিত করে তোলছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, আশ্রয় ক্যাম্পগুলোতে মিয়ানমার থেকে বিভিন্নভাবে অস্ত্র আসছে। মিয়ানমার সরকারের একটি বাহিনীর সহযোগিতায় এসব অস্ত্র আসছে উখিয়া টেকনাফের আশ্রয় ক্যাম্পে। এর কারণ হচ্ছে প্রথমত ইয়াবা-আইস স্বর্ণ আনা-নেয়ায় অস্ত্র ব্যবহার করা, দ্বিতীয়ত ক্যাম্পে প্রত্যাবাসনবিরোধী কার্যক্রম চালু রাখতে সন্ত্রাসীদের অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ দেয়া। গত দুইদিন ধরে এক রোহিঙ্গা নারীর হাতে অস্ত্র চালানোর ভঙ্গিমার একটি ছবি সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে রীতিমতো ভাইরাল হয়েছে।
সীমান্তের একাধিক সূত্র থেকে জানানো হয়েছে, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে মাদক আনতে রোহিঙ্গারা ব্যবহার করে ওই অস্ত্র। স্থল ও সাগরপথে অস্ত্র সহকারে মাদকের চালান নিয়ে যাচ্ছে ইয়াবা ডনরা। মিয়ানমারে প্রতিষ্ঠিত মাদক কারখানাগুলোতে দেশটির সেনাবাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তা মালিকানার অংশীদার থাকায় এসব মাদক পাচার কাজে তাদের অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে একটি বাহিনী। উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে ঘিরে আরসা বা আল ইয়াকিনের সদস্য রোহিঙ্গা সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের তৎপরতায় স্থানীয়রা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
মাদক, ইয়াবা, ক্রিস্টাল আইস, স্বর্ণ, মানবপাচার, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি, খুন ও কর্মকা-ে ক্যাম্পে ভীতির সৃষ্টি করছে ওইসব ক্যাডার। এসবের পেছনে রয়েছে রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রিত সশস্ত্র বাহিনী আরসা বা আল-ইয়াকিন।
ক্যাম্পে এখন মূর্তিমান আতঙ্ক ‘আরসা’ পরিচয়ে সন্ত্রাসী দল রাতের বেলায় দাপিয়ে বেড়ায়। অনুসন্ধান ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য। আরসা বা আল ইয়াকিন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের মূল লিডার হাফেজ আতাউল্লাহ ওরফে আবু আম্মর জুনুনীর বডিগার্ড হিসেবে সার্বক্ষণিক সশস্ত্র পাহারায় থাকে ৫ সশস্ত্র ক্যাডার।
তার অপরাপর সদস্যরা থাকে বালুখালী ক্যাম্প ৮/ই বøকসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে। আবু আম্মর জুনুনি পাকিস্তানের করাচিতে জন্ম নেয়া একজন রোহিঙ্গা। যিনি সৌদি আরবের মক্কায় বড় হয়েছেন। এছাড়া সৌদি প্রবাসী রোহিঙ্গাদের একটি কমিটিও তার নেতৃত্বে রয়েছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা গোলাম শরীফের পুত্র আরসা নেতা হাফেজ আতাউল্লাহ ওরফে আবু আম্মর জুনুনি তার সহযোগীদের নিয়ে বর্তমানে মিয়ানমারের জিরো পয়েন্টে রোহিঙ্গা বস্তিতে অবস্থান করছে। ওপারের ওই রোহিঙ্গা বস্তির প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গার জন্য অবৈধভাবে ত্রাণসামগ্রী পাচার করছে একটি এনজিও। আরসা কমান্ডার জুনুনি দুই বার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮ এ এসেছিলেন। আরসা সশস্ত্র গ্রæপের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠকও করে গেছেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান, আগুন সন্ত্রাস, সন্ত্রাসী কর্মকা-, ইয়াবার গডফাদার ও মানব পাচারকারী হিসেবে পরিচিতি এই হাফেজ আতাউল্লাহর সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে লিয়াজোঁ রয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, বর্তমানে রোহিঙ্গাসহ স্থানীয় বাংলাদেশীদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করছে আরসা বাহিনীর সদস্যরা। উখিয়া ও টেকনাফবাসীদের পাশাপাশি সাধারণ রোহিঙ্গারাও আরসাকে জঙ্গী বাহিনী বলে আখ্যা দিয়েছে। উখিয়া ও টেকনাফের প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কথিত আরসা বা আল-ইয়াকিনের সদস্যরা।
সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আরসা সদস্য তুমব্রæ জিরো পয়েন্টে অবস্থানকারী মাস্টার ওলা মিয়ার পুত্র মাস্টার দিল মোহাম্মদ, মাস্টার আরেফ আহম্মেদ, ক্যাম্প-৮ এ অবস্থানকারী আরসা ও আল ইয়াকিনের সেকেন্ড ইন কমান্ড হোসাইন আলীর পুত্র ফয়জুল কবির ওরফে মৌলবি আবু আনাস সরকার বিরোধী তথা প্রত্যাবাসন ঠেকাতে মরিয়া।
এই মৌলবি আবু আনাসে কাছেই আরসা বা আল ইয়াকিনের ভারি অস্ত্র মজুদ থাকে। ক্যাম্প-৮-ই বøক-বি ৩৪ এ গোলাম কাদেরের পুত্র মৌলবি হামিদুল্লাহ ক্যাম্পে নারীদের নির্যাতন করে। বিভিন্ন অসহায় মহিলাদের অস্ত্র দেখিয়ে হুমকি দিয়ে ধর্ষণ করে এবং আরসা কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। ক্যাম্প-৮-ই বøক-২৪০, ডিআরএস টিম লিডার ও ফয়জুল কবিরের পুত্র মোহাম্মদ আয়াছ আল ইয়াকিনের সব তথ্য আদান প্রদান ও কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করে আসছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৩ ও ৭, বালুখালী ক্যাম্প-৮ ও ৮- ইস্ট ৯ ও ১০, থাইংখালী জামতলীর ক্যাম্প-১৫, ক্যাম্প-২১ সহ বহু ক্যাম্পে রাতদিন আরসার বিচরণ রয়েছে। তবে উদ্বেগজনকভাবে বেশি বিচরণ রয়েছে বালুখালী ক্যাম্প-৮ এ।
সেখানে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের অস্ত্র চালানার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। এর কারণ হিসেবে সাধারণ রোহিঙ্গারা জানায়, মিয়ানমার সীমান্তের জিরো পয়েন্ট থেকে উখিয়া বালুখালী ক্যাম্প-৮, ৯ ও ১১ নম্বরে সহজে প্রবেশ করতে পারে এবং যাতায়াতের জন্য সুবিধাজনক। এছাড়াও চোরাগলি দিয়ে মিয়ানমারে যাতায়াতের মাধ্যমে ইয়াবা, আইস ও স্বর্ণের বারের বড়-বড় চালান ক্যাম্প অভ্যন্তরে ঢুকানো যায়। এসব ব্যবসা এবং আধিপত্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিজেরাই কথিত আরসা গ্রæপ সৃষ্টি করে নানামুখী অপকর্ম করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, মাদক ও চোরাচালান পণ্য ক্যাম্পে প্রবেশ করতে রাত-বিরাতে সশস্ত্র গ্রæপ বালুখালীর জুমের ছড়া, বালুখালীর ফুটবল খেলার মাঠ, মরাগাছ তলা নামক জায়গায় বের হয়ে সীমান্ত পথে মিয়ানমারে যাতায়াত করে রোহিঙ্গা ক্যাডাররা। ফলে স্থানীয়রাও ভয়ে-আতঙ্কে থাকেন সবসময়। রোহিঙ্গাদের মতে, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ বাণিজ্য, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অনেক হত্যার ঘটনা ঘটেছে গত চার বছরে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের পাহাড়ী ক্যাম্পে এত অস্ত্র- গোলাবারুদ আসছে কোত্থেকে? তা-ও আবার অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র। এদের অস্ত্রের জোগানদাতা কারা।
কথিত আল ইয়াকিন সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা নারীদের হাতেও অস্ত্র তুলে দিয়েছে। তাদেরকে প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে অস্ত্র চালনার। বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত সশস্ত্র রোহিঙ্গারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের (নারী ও পুরুষ) অস্তিত্ব জাহির করতে ছবি দিয়ে প্রচারও চালাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করে এক পল্লীচিকিৎসক জানান, আরসার উৎপাতে ক্যাম্পগুলোতে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। সবার মনে একটা ভয় তৈরি হয়েছে যে, আরসার বিরুদ্ধে কথা বললে সশস্ত্র আরসা সন্ত্রাসীরা অঘটন ঘটাতে পারে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বে নিয়োজিত একটি সংস্থার সদস্য জানান, উল্লেখিত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। তাদের বিষয়ে ব্যাপক তথ্য-উপাত্ত রয়েছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ কামরান বলেন, ক্যাম্পে আশ্রিত সন্ত্রাসীরা পুলিশের তালিকাভুক্ত। কোন গ্রæপকে ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাতে দেয়া হবে না। যারা সন্ত্রাসী কাজে জড়িত- তাদের বিষয়ে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক এসপি মোঃ নাইমুল হক পিপিএম জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কোন গ্রæপ থাকতে পারবে না। এপিবিএন সদস্যরা ক্যাম্প অভ্যন্তরে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে ২২০ জন কথিত আরসা সদস্যসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত প্রায় ৯শ’ রোহিঙ্গা দুষ্কৃতিকারীকে গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *