নিজস্ব প্রতিবেদক:
কক্সবাজার শহর থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়কের পর্যটন স্পট হিমছড়ি সংলগ্ন মারমেইড বিচ রিসোর্টের বিরুদ্ধে সমুদ্র সৈকত দখলের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
রাজনৈতিক ও পেশিশক্তির জোরে আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দখল কাজ অব্যাহত রেখেছে মারমেইড বীচ কতৃপক্ষে। এখনো চলছে তাদের দখলদারিত্ব ও রামরাজত্ব।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরেও থামেনি তাদের অপতৎপরতা । বরং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময়টায় পুলিশ-প্রশাসনে অস্থিরতা ও নিষ্ক্রিয়তায় দখলবাজারদের আরও বেপরোয়া করে তুলেছে।
জানা যায়,
কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়কের পর্যটন স্পট হিমছড়ি সংলগ্ন মারমেইড বিচ রিসোর্টের নামে একটি প্রতাপশালী ভূমিদস্যু চক্র বীচের বালিয়াড়ি জবরদখল করে রিসোর্টের আকার বৃদ্ধি করছে। তাদের বিরুদ্ধে সমুদ্র সৈকত দখলের অভিযোগ নতুন নয়। এবার ডিজে ও মদের পার্টির জন্য বিশেষ জোন তৈরি করেছে ঝাউবিথীর বাগানে। যার নাম দেয়া হয়েছে ‘ফুল মুন বিচ পার্টির নামে দেশি-বিদেশি মদের আড্ডা খানা। পতিতাদের অবাধ বিরণক্ষেত্র বললে ও চলে। যেখানে কাটা পড়েছে শত শত ঝাউগাছ। সমুদ্র সৈকত রক্ষায় রোপণ করা ঝাউবিথী উপড়ে ফেলা হয়েছে। যার ফলে পরিবেশের পাশাপাশি ক্ষতিরমূখে পড়ছে দেশের একমাত্র মেরিনড্রাইভ সড়ক।
স্থানিয় সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল,সাবেক আইসিটি মন্ত্রী পলক সহ একাধিক মন্ত্রী-প্রভাবশালী নেতার দাপট দেখিয়ে একের পর এক সমুদ্রের বালিয়াড়ি দখল করেছেন রিসোর্টটির মালিক আনিসুল হক চৌধুরী সোহাগ। নিজেকে শেখ পরিবারেরই একজন দাবী করা সোহাগ একের পর এক দখল চালিয়ে গেলেও গেল ১৫-১৬ বছরে প্রশাসনের কেউ সেদিকে নজর দেননি অদৃশ্য কারণে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পর্যটক বা স্থানীয়রা তাদের নির্মিত সেতু দিয়ে সেখানে প্রবেশ করতে চাইলে বাধা দেয়া হয়। পরবর্তীতে বিশেষ সংকেত পেলে প্রবেশ করতে পারে পর্যটকরা। স্থানীয়দের বার বার ফিরিয়ে দেয়া হয়। সেখানে গিয়ে দেখা মিলে শত শত ঝাউবিথী কেটে তৈরি করা হয়েছে নাচ-গানের মঞ্চ, কফি সপ, বা মদের বার সাদৃশ্য বিশেষ জোন। এটি মূলত সমুদ্রে গজিয়ে উঠা একটি চর। সেখানে দীর্ঘদিন থেকে ঝাউবিথী রোপণ করে উপকূলীয় বন বিভাগ। যা কেটে অবকাঠামো তৈরি করেছে মারমেইড বিচ রিসোর্ট। প্রতি বছর তারা পর্যটকদের গলাটিপে কোটি কোটি টাকা পকেটে ভরে। উক্ত রিসোর্টের একমাত্র রক্ষক সোহাগ।
আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতার বলয়ে অপ্রতিরোধ্য দখলবাজ সোহাগ হাজার কোটি টাকার মালিক
কক্সবাজার সৈকত ও বালিয়াড়িতে প্রাইভেট বীচ
মারমেইডের স্থাপনায় জবরদখলে রাখা অধিকাংশই সরকারি খাস জমি।
ফ্যাসিবাদের শীর্ষ দোসরখ্যাত দখলবাজ সোহাগ সৈকতের বহু জায়গা জবরদখল করে রেখেছেন মারমেইড রিসোর্টর নামে। এভাবে জবরদখকরা বালিয়াড়ি এলাকায় অবৈধ স্থাপনা করে গত ১৫ বছরে তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক এখন। কথিত সোহাগ উচ্চ পর্যায়ের আমলা ও শেখ হাসিনার চেলাচামুন্ড দের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে দখলে নিয়েছেন সাগর লাগোয়া কোটি কোটি টাকার সরকারি খাস জমি। মারমেইডের স্থাপনায়-জবরদখলে অধিকাংশ জমি খাস জানা সত্বেও ওই হোটেল মালিকের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাবেক আমলা মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে দহরম-মহরম সম্পর্ক রয়েছে জেনে স্থানীয় প্রশাসন কোন ধরণের আইনানূগ ব্যবস্থা গ্রহণকল্পে সাহস করেননি।
অভিযোগ উঠেছে, বিগত স্বৈরাচার
সরকারের আমলে আওয়ামীলীগ সরকারের একাধিক মন্ত্রী-প্রভাবশালী নেতার বল দেখিয়ে একের পর এক সমুদ্রের বালিয়াড়ি দখল করেছেন রিসোর্টটির মালিক আনিসুল হক চৌধুরী সোহাগ।
বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি কক্সবাজার-রামু আসনে নৌকার টিকেট নিতেও দৌড়ঝাপ শুরু করেন। পরে ও ব্যর্থ হন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সোহাগের সখ্যতার ধারাবাহিকতায় প্রশাসনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বহমান খালের উপর সম্প্রতি অবৈধ একটি সেতু নির্মাণ করেছে।
নতুন করে বহমান খাল দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে সেতু। যার অনুমতি নেননি হোটেল মালিক সোহাগ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে খুনিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের একজন ইউপি সদস্য বলেন, মূলত মারমেইড বিচ রিসোর্টটি পড়েছে রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নে। প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে উন্মুক্ত বহমান খালের উপর মারমেইড বিচ কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি সেতুটি নির্মাণ করে। মারমেইড বিচ কর্তৃপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ার কারণে কোন কিছুই তোয়াক্কা করছে না। তারা সম্প্রতি রাতের আঁধারে সেতুটি নির্মাণ করে অবৈধভাবে। কারণ চলমান খালের উপর সেতু নির্মাণ করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। বিষয়টি স্থানীয় জনগণের দৃষ্টিগোচর হলে এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে অভিযোগ আকারে অবহিত করা হয়। পরে উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ এসে বিষয়টি দেখে চলে যায়। অভিযোগ উঠেছে, প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই মারমেইড বিচ কর্তৃপক্ষ সেতুটি খালের উপর দৃশ্যমান রেখেছে। ওই ইউপি সদস্য আরও জানান, মারমেইড বিচ রিসোর্টের মালিক সোহাগ স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে নামমাত্র মুল্যে হুমকি-ধামকি দিয়ে কিছু খতিয়ানভূক্ত জমি ক্রয় করেন। তারপর থেকে সেই জমির পাশে গজিয়ে উঠা সমুদ্র সৈকতের বিশাল বালিয়াড়ি এলাকা অবৈধ দখলে রেখেছে। মারমেইড বিচ রিসোর্টের বিশাল এলাকার অধিকাংশই খাসজমি ও সৈকতের বেলাভূমি। অল্প সংখ্যক জমি কিনে পাশের খাস জমি ও সৈকতের বালিয়াড়ির জমির মধ্যেই গড়ে উঠেছে মারমেইড বিচ রিসোর্ট।
সমুদ্র সৈকতের বিশাল এলাকা দখলে রেখে গলাকাটা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে মারমেইড বিচ কর্তৃপক্ষ।
সরকারের আদেশ অমান্য করে তৈরি করা হয় নানা স্থাপনা। বালিয়াড়ি, পাথরময় জোয়ার-ভাটা অঞ্চল, উপকুলীয় জলাভূমী ও কোরালসহ সামূদ্রিক দ্বীপ রক্ষায় কক্সবাজারের সৈকত এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করে ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল এ সংক্রান্ত গেজেটও প্রকাশ করে সরকার। এ নির্দেশনা মতে, ১২০ কিলোমিটার সমুদ্রসৈকত, সৈকতের ঝাউ গাছসমৃদ্ধ ৩০০ মিটারে যে কোনো স্থাপনা নির্মাণ ও উন্নয়ন নিষিদ্ধ ও ৫০০ মিটার সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি মারমেইড বিচ রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ সেই আদেশ অমান্য করে সবকিছুই তৈরি করেছেন। এছাড়া, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা এক রিটের বিপরীতে ‘ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান ফর কক্সবাজার টাউন অ্যান্ড সি আপ টু টেকনাফ’ মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী জোয়ার ভাটার মধ্যবর্তী লাইন থেকে প্রথম ৩০০ মিটার ‘নো ডেভেলপমেন্ট জোন’ উল্লেখ করে এ এলাকায় কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না বলে নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত। এর সঙ্গে যুক্ত হয় কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাস্টারপ্ল্যান। এ প্ল্যান বাস্তবায়নে কউক সমুদ্র সৈকতের ৩০০ মিটারে কোন স্থাপনা নির্মাণ থেকে বিরত থাকতে প্রচারণা চালায়।
স্থানিয় পরিবেশবাদীদের মতে দ্রুত সময়ের মধ্যে ইসিএ এলাকায় সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করা দরকার। অন্যথায় পরিবেশগত বড় হুমকিতে পড়বে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। তাই এখনই সময় দখলদাররা যতই প্রভাবশালী হোক তাদের লাগাম টেনে ধরতে হবে। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন হিমছড়ি টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান জানান, রাতের আধারে ঝাউবিথী কেটেছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। কিন্তু গভীর রাতে কাটায় আমরা তাদের ধরতে পারছি না। তবে মারমেইড কর্তৃপক্ষ সেখানে অবকাটামো তৈরি করেছে, সেবিষয়ে জেলা,উপজেলা প্রশাসন দেখবেন। এটি আমাদের দায়িত্ব না।
এ ব্যাপারে মারমেইড বিচ রিসোর্টের মালিক আনিসুল হক চৌধুরী সোহাগের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
জেনারেল ম্যানেজারের সাথে কথা বললে তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেননা বলে জানান।
এ বিষয়ে জানতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কে রাতে প্রতিবেদন তৈরির সময় একাধিকবার ফোন দিয়ে ও সংযোগ দেয়া সম্ভব হয়নি।