সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ০৩:৩৬ অপরাহ্ন
দুদক’র অভিযানেও থামছেনা সুগন্ধায় স্থাপনা নির্মাণ
বিশেষ প্রতিনিধিঃ
নাটকিয়তার শেষ হচ্ছেনা সুগন্ধার সেই বিতর্কিত ৩০০ কোটি টাকার জায়গা নিয়ে। দুদকের অভিযানের পরও আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী সেই বিতর্কিত ওবায়দুল হোসেনের নেতৃত্বে জাল খতিয়ান সৃষ্টি করে সরকারী জায়গায় স্থাপনা নির্মান বন্ধ নেই। যেন কে শুনে কার কথা। দুদকের অভিযান আর জেলা প্রশাসনের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে স্থাপনা নির্মান যেন চালাতেই হবে। যে যাই বলুক আমার কাজ আমি করে যাব এই ভাব দখলবাজদের। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বাইরে তালা মেরে প্রতিনিয়ত স্থাপনা নির্মান করছে ভিতরে। এদিকে প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন কর্মকান্ডেও জেলা প্রশাসন জেনে ও না জানার ভান করে দখলের সুযোগ করে দিচ্ছে এমন অভিযোগ সচেতন মহলের। প্রশাসন, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীদের তত্বাবধানে একটি সিন্ডিকেট এ জবর দখলে জড়িত এমন অভিযোগ তাদের। জাল জালিয়াতি কাগজে জবর দখলের বিষয়ে সুস্পষ্ট জানার পরও জেলা প্রশাসন কেন কার্যকর কোন উদ্যোগ নিচ্ছেনা তা সাধরণের মাঝে বড় এক প্রশ্ন। জেলা প্রশাসন জেনে শুনেই তাদেরকে স্থাপনা নির্মানে সহযোগিতা করছে এমন অভিযোগ সুশিল সমাজের। এ যেন জেলা প্রশাসনের সাথে অবৈধ দখলদারদের মাঝে চোর-প্রশাসন খেলা চলছে। সচেতন মহলের প্রশ্ন- জেলা প্রশাসনের চেয়েও কি শক্তিশালী সুগন্ধার দখলদার? আওয়ামীলীগ নেতা ও ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর ওবায়দুল হোসেনের এত ক্ষমতার উৎস কোথায়? একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় একজন ফ্যাসিস্ট হয়েও এত ক্ষমতা পেয়েছে বলে জানান অনেকে। সাথে কয়েকজন সাংবাদিক ও জোট বেঁধেছে বলে জানান তারা।
এরই মধ্যে গত ৫ মে সোমবার সুগন্ধার সেই আলোচিত সরকারি জায়গায় অভিযান পরিচালনা করছেন দুর্নীতি দমন কমিশন ( দুদক’র) একটি টিম। দুদক কক্সবাজার সমন্বয় অফিসের সহকারী পরিচালক ( দুদক) অনিক বড়ুয়ার নেতৃত্বে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। দুদক’র টিম সুগন্ধার ও-ই জায়গায় পৌঁছালে ভিতরে ও বাইরে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয় দখলদারদের পক্ষ থেকে। ভিতরে সাড়াশব্দ থাকলে-ও কেউ দরজা না খোলায় অনেকটা ক্ষুব্ধ হয় দুদকের সদস্যরা। পরে অনেকটা জোর করেই প্রবেশ করতে হয়েছে দুদকের অভিযানিক দলকে।
অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া সহকারী পরিচালক ( দুদক) অনিক বড়ুয়া জানান, শহরের সুগন্ধার কয়েকশো কোটি টাকার সরকারি জমি জাল খতিয়ানে দখলের পায়তারার অভিযোগ পেয়ে দুদকের একটি টিম অভিযানে যায়। কয়েকদিন থেকে সুগন্ধার সরকারি একটি জায়গা নিয়ে জাতীয় এবং স্থানীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারের বিষয়টি নজরে আসে। এছাড়া ওই জায়গা সম্পূর্ণ সরকারি একটি জায়গা। কিছু অসাধু ব্যাক্তি উক্ত জায়গা দখল করে মার্কেট নির্মাণ করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ও-ই জায়গা যে ব্যাক্তি নিজের মালিকানাধীন জায়গা বলে দাবি করছে তাকে নিয়ে ও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এরকম অভিযোগে পেয়ে আমাদের একটি টিম অভিযান যায়। কিন্তু অনেক্ক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও দরজা খুলতে পারিনি। পরে গণমাধ্যম কর্মীরাসহ দরজা খুলতে সক্ষম হই। দুদক টিম সরেজমিনে সরকারী জায়গায় জবর দখল করে বেশ কিছু দোকান বা স্থাপনা নির্মাণ করার প্রমান পেয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে আইনানুগ যা করার দুদক তা করবে। একই সঙ্গে জাল খতিয়ান ও দলিল তৈরির মদদদাতা প্রভাবশালী ব্যক্তি বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকলে, তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে।
এদিকে ও-ই সময় দুদকের অভিযানের খবর পেয়ে সংবাদ কাভার করতে উপস্থিত হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকেরা। সাংবাদিক দেখে ক্ষিপ্ত হয় সেখানে দায়িত্বরত কেয়ারটেকার শিমুল।
তার কাছে জানতে চাইলে, তিনি বলেন, আমিসহ নয়ন ও কাজল বড়ুয়া এই জায়গার দেখভালের দায়িত্ব আছি। কে বা কারা তাঁদের দায়িত্ব দিয়েছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ সচ্চিদানন্দ সেন গুপ্তের লোকের নির্দেশে তারা কাজ করছেন। এখানে আর কে বা কারা জড়িত আছে জানতে চাইলে তিনি কোন উত্তর না দিয়ে পাশ কেটে যায়।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকরা জানান, দুদকের অভিযানের খবর পেয়ে সেখানে উপস্থিত হয় সাংবাদিকেরা। কিন্তু সংবাদকর্মীদের দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে কেয়ারটেকার দাবী করা সেই শিমুল। ও-ই সময় তার হাতে একটি অস্ত্র সদৃশ বস্তুু দেখা যায় বলে দাবি করেছেন সাংবাদিকেরা।
জানা যায়, ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল সরকার টেকনাফ থেকে নাজিরার টেক পর্যন্ত এলাকাকে পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ( ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে ২০১১ সালে উচ্চ আদালতের এক রায়ে কলাতলীর হোটেল-মোটেল জোনের ৪৯টি প্লট একসাথে বাতিল করে। এরপর ২০১৮ সালে আরেকটি রায়ে হোটেল -মোটেল জোন এলাকাসহ ১ নং খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করেন। বিশেষ ২০০০৩ দাগের ৩৯ দশমিক ৭৮ একর জমি সম্পূর্ণভাবে খাস হয়ে যায়। সচ্চিদানন্দ সেনের দাবিকৃত সুগন্ধার সেই আলোচিত জমির ২ দশমিক ৩ একর জায়গায় সরকারের ১ নং খাস খতিয়ানের জায়গা।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছেন, ২০০০৩ দাগের সম্পূর্ণ জমি সরকারের ১ নং খাস খতিয়ানের জায়গা। বাতিলকৃত প্লটের ২ একর ৩০ শতক খাস জমি সচ্চিদানন্দ সেনগুপ্ত নামের এক ব্যক্তির জমি দাবি করে জাল কাগজপত্র বানিয়ে রাতারাতি মার্কেট নির্মাণের কাজ শুরু করে হাইকোর্টের দোহাই দিয়ে। তাদের সেই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ সুপ্রীম কোর্টে আপিল করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত স্থিতিবস্থা জারি করেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক অনিক বড়ুয়া বাবু পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ এটি সরকারি খাস জমি। জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশ মুক্তেিযাদ্ধা প্রজন্মলগি কক্সবাজার জেলার সহ-সহভাপতি ওবাইদুল হাসানের নেতৃত্ব একটি দখলবাজচক্র দখলে নিয়ে অবৈধ দোকানপাট নির্মাণ করছে এটা আমরা নিশ্চিত হয়েছি। এখন আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব। তিনি আরো বলেন, চক্রটি দুদকের দলকে পরিদর্শনে বাধা প্রদান করেছে। এ বিষয়েও আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুশিল সমাজের প্রতিনিধি আবু জাফর বলেন, প্রশাসনের নাকের ডগায় এতদিন ধরে জাল জালিয়াত করে কোটি কোটি টাকার সরকারী জায়গা অবৈধ দখল করে দোকান ঘর নির্মান করে যাচ্ছে। তা সহজ বিষয় নয়। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন দায় এড়াতে পারেনা। এ যেন জেলা প্রশাসনের সাথে অবৈধ দখলদারদের মাঝে চোর-প্রশাসন খেলা চলছে। অতি দ্রুত জেলা প্রশাসনকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে দখলমুক্ত করার দাবী জানাচ্ছি।
পরিবেশবাদী নেতা কলিম উল্লাহ কলিম বলেন, এত নাটক কেন করা হচ্ছে সুগন্ধা নিয়ে? এলাকাটি ইসিএ এলাকভুক্ত এলাকা, তবুও কেন প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে স্থাপনা নির্মানের সুযোগ পাচ্ছে? এরা কি জেলা প্রশাসনের চেয়ে শক্তিশালী? যত দ্রুত সম্ভব এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করার জন্য জেলা প্রমাকের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি। ইসিএ এলাকায় আর কোন স্থাপনা আমরা দেকতে চাইনা।
কউকের উপ-নগর পরিকল্পনাবিদ তানভীর হাসান রেজাউল বলেন, সচ্চিদানন্দ সেন নামের ওই ব্যাক্তি ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ওই জমি ব্যবহারের জন্য কউক বরাবর আবেদন করেন। কিন্তু কাগজ যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে দেখা সব কাগজই ভুয়া এবং নথি জালিয়াতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এর পর ২০২৪ সালের ১২ জুন জেলা প্রশাসন ও ভূমি অফিসের কাছে এক চিঠি দেন এবং ওই চিঠিতে ভুয়া কাগজপত্র ও সরকারের নথি জালিয়াতি করার কারনে সচ্চিদানন্দ সেনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। উপ নগর পরিকল্পনাবিদ মো. তানভীর হাসান রেজাউল আরো বলেন,‘ যে কোন স্থাপনা নির্মাণের আগে কউকের ভূমি ব্যবহারের অনুমোদন নিতে হয়। সুগন্ধা পয়েন্টের ওই জমিতে কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি।’
জাল খতিয়ানে স্বাক্ষর রয়েছে কক্সবাজার সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ উল্লাহ নিজামীর। তুলনাকারক হিসেবে ভূমি অফিসের নাজির মোহাম্মদ আলমগীর ও নকলকারক হিসেবে কর্মচারী মোহাম্মদ আয়াছের স্বাক্ষর আছে।
পরে ভুমি অফিসের তৎকালীন সহকারী কমিশনার ( ভুুমি) আরিফ উল্লাহ নিজামী তার বিরুদ্ধে সদর থানায় একটি জিডি করে এবং পরবর্তীতে সেটি মামলায় রুপান্তরিত হয়।
এ বিষয়ে তিনি আরিফ উল্লাহ নিজামী বলেন, ‘আমাদের স্বাক্ষর জাল করে খতিয়ান সৃজন করে একটি চক্র সরকারি জায়গাটি দখল করতে চেয়েছে। আমি বিষয়টি জানার পর সাথে সাথে সদর মডেল থানায় একটি জিডি করি। তিনি বলেন, ওই ব্যাক্তিকে আমি জীবনেও চোখে দেখিনি। তার সাথে জাল জালিয়াতির একটি বিশাল চক্র জড়িত আছে’।
কক্সবাজার সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শারমিন সুলতানা জানান, জাল কাগজ বানিয়ে সরকারি খাস জমি দখলের বিষয়টি জেলা প্রশাসনের নজরে আসার পর সচ্চিদানন্দ সেনগুপ্তসহ দুইজনের বিরুদ্ধে সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া ভূমি অফিসের রেকর্ডপত্র দেখে, সচ্চিদানন্দ সেনগুপ্ত নামে কোনো ব্যক্তির খতিয়ানের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ পরিচয়ধারী ওবায়দুল ১২টি মামলার আসামি। তবে সব মামলায় জামিনে রয়েছে তিনি। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় জেলা বিএনপি অফিস পোড়ানোর মামলায় দুই মাস কারাগারে আটকও ছিলেন।
এদিকে আওয়ামী লীগার পরিচয় দিয়ে অবৈধ কাজে জড়িত থাকার বিষয়টি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর নানাভাবে চাপের মুখে পড়ে ওবায়দুল তার চক্রে এখন ঠাঁই দিতে শুরু করেছেন বিএনপির লোকজনকে। এমনকি যে জেলা বিএনপি অফিস পোড়ানোর মামলায় ওবায়দুল আসামি সেই বিএনপি অফিস তিনি আবার নির্মাণ করে দেওয়ার দাবি করেছেন। এ নিয়ে কক্সবাজারের রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় চলছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( রাজস্ব) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, সচ্চিদানন্দ সেনের পক্ষে একটি চক্র জাল খতিয়ান করে সরকারের জমি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে। সচ্চিদানন্দ সেনের নামে কোনো খতিয়ান নেই। আমি থাকাকালীন তাঁদের কাগজপত্র ঘেঁটে দেখেছি। সব কাগজেই গরমিল রয়েছে। আমি সবকিছু যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। যেখানে ও-ই ব্যাক্তির কোন জায়গায় নেই এবং এই জায়গা মালিক সরকার।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন,‘ সরকারি খাস জমি দখলের বিষয়টি নজরে আসার পর সবধরণের স্থাপনা সরিয়ে নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই না সরালে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।
জেলা প্রশাসক মো সালাহউদ্দিন বলেন, তাঁদেরকে সময় দেওয়া হয়েছে স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার জন্য। শুনেছি এখনো স্থাপনা সরানো হয়নি। শিগগিরই না সরালে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।