রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৮ পূর্বাহ্ন

উপকূল ঘিরে ফের সক্রিয় মানবপাচারকারী চক্র

বিশেষ প্রতিবেদক:

কক্সবাজার উপকূলে শরৎ মৌসুমের শুরুতেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে মানব পাচার চক্র। পাচারকারী চক্রের প্রধান টার্গেটে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। বঙ্গোপসাগর উপকূলে অবস্থিত সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ ও উখিয়ায় অন্তত দুই শতাধিক মানবপাচারকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। ইতোমধ্যে ৫ জন মানবপাচারকারী আটক হলেও স্থানীয়রা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপ্রতুল তৎপরতার কারণে বেপরোয়া পাচার বাণিজ্য করছে মানবপাচারের একটি বড় সিন্ডিকেট। বর্তমানে তারা ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলকে।

রোহিঙ্গাদের দাবি, স্থানীয় ও রোহিঙ্গা দালালচক্র নানা প্রলোভন দেখিয়ে পাচারের উদ্দেশ্যে তাদের জিম্মি করে। তবে অনুসন্ধান ও তদন্তের মাধ্যমে দালালদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ, যার পাশেই সমুদ্র উপকূল। এতে রয়েছে ডিঙি নৌকা। আর ডিঙি নৌকার পয়েন্টগুলো ব্যবহার হচ্ছে মানবপাচারের ট্রানজিট হিসেবে।

সাগরপথে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য ক্যাম্পে প্রচারণা চালাচ্ছে কয়েকটি দালালচক্র। তারপর সাধারণ রোহিঙ্গাদের জিম্মি করে রাতের আঁধারে আনা হচ্ছে উপকূলবর্তী ঘাটে। এরপর স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় উপকূলের ডিঙি নৌকার মাধ্যমে তুলে দেয়া হচ্ছে সাগরে থাকা বড় ট্রলারে।

মূলত রোহিঙ্গা দালালরাই সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের এ রুটটি আবিষ্কার করে। অস্বচ্ছল ও বেকার যুবকদের জীবন বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে নগদ ১০ থেকে ২০ হাজার ও দেড়-দুই লাখ টাকা বাকিতে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার শর্তে ফাঁদে ফেলছে, বিশেষ করে যুবকদের। মালয়েশিয়া যাবার জন্য চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিভিন্ন সমুদ্র উপকূল ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমে ছোট নৌকাযোগে উপকূল থেকে সমুদ্রে বড় জাহাজে তুলে দেয়া হয়। সেই ট্রলারে ১০ দিন পর থাইল্যান্ড পৌঁছে দেয়। থাইল্যান্ডে অবস্থানের সময় ২ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মুক্তিপণ আদায় করা হয়। মুক্তিপণ পেলে মালয়েশিয়ার জঙ্গলে বিভিন্ন খামারে শ্রমিক হিসেবে পাঠানো হয়। কারও মুক্তিপণ পাওয়া না গেলে তাদেরকে থাইল্যান্ডে দাস শ্রমিক হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়। অথবা দিনের পর দিন সেখানে নির্যাতন চালানো হয়। এমন নির্যাতনে মারাও গেছেন অনেকেই।

মাস ধরে মানব পাচারকারী চক্র আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে চক্রগুলো কয়েকটি চালান পাচার করে দিয়েছে বলেও তথ্য রয়েছে। এসব চক্রে রয়েছে মহেশখালী, উখিয়া, রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও টেকনাফের অন্তত শতাধিক পাচারকারী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূল দিয়ে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর কাজে জড়িত অন্তত ৫০০ দালালকে তারা চিহ্নিত করেছে। এদের অবস্থান দেশের ১৮টি জেলায়।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়া, টেকনাফ সদর ইউনিয়ন, বাহারছড়া ইউনিয়ন, শাহপরীর দ্বীপ ও উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং ইউনিয়নের উপকূলে পাচারকারী সিন্ডিকেটগুলো মানবপাচার করে থাকে। উল্লেখিত এলাকাগুলোর বেশিরভাগ মেরিন ড্রাইভ উপকূলের কাছে হওয়ায় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে সহজে মানবপাচার করে থাকে।

জানাগেছে, উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবির থেকে কৌশলে পালিয়ে দালালের হাত ধরে রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করছে। এভাবে গত ৪ অক্টোবর ও ২০ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়া যাবার চেষ্টার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ৬০ জন। এদের মাঝে ২০ জন বাংলাদেশি বাকিরা রোহিঙ্গা। গত সেপ্টেম্বরে প্রথমবার ১৫ জনকে মানব পাচারকারী চক্রের হাত থেকে উদ্ধার করে পুলিশ-বিজিবি। এর আগে গত বছরের নভেম্বরে দালাল চক্র মালয়েশিয়া নেওয়ার কথা বলে দু’দিন ধরে সাগরে এদিক-ওদিক ঘোরানোর পর থাইল্যান্ডের তীরে পৌঁছেছি বলে টেকনাফের সৈকতে ১৪ রোহিঙ্গাকে নামিয়ে দেয়।

পরে বিজিবি তাদের উদ্ধার করে। একই বছর ৭ নভেম্বর একইভাবে আরও ৩৩ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। এ সময় ৬ দালালকেও আটক করা হয়। আইনশৃংখলা বাহিনীর দেওয়া তথ্যমতে, সাগর পথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টায় গত বছরের ৬ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দফায় কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫৪৯ জন রোহিঙ্গা ও ২১ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের মাঝে বেশিরভাগই নারী।

অনুসন্ধানে জানাগেছে, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ও বাহারছড়া উপকূল দিয়ে বেশিরভাগ মানুষ মালয়েশিয়া যাচ্ছে। এখানে দালালচক্রের নেতৃত্বে আছে শাহপরীর দ্বীপের ধলু হোসেন ও শরীফ হোসেন। তাদের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় ১২টি মামলা রয়েছে। তবে ধলু ও শরীফ সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এ ছাড়াও দালাল হিসেবে টেকনাফের সাবরাং এলাকার আকতার কামাল, সাঈদ কামাল, মোয়াজ্জেম হোসেন; রামুর কালিমারছড়ার মোহাম্মদ হোসেন, শাহপরীর দ্বীপ মাঝেরপাড়ার জায়েত উল্লাহ, সব্বির আহাম্মদ, সাজেদা বেগম, আব্দুল্লাহ, ইউনুচ, কলিম উল্লাহ, আব্দুস শুক্কুর, ঘোলাপাড়ার শামসুল আলম, কবির আহমদ, হাজীপাড়ার মুজিব উল্লাহসহ অন্তত ২৫০ জনের নাম এসেছে।

টেকনাফের বাইরে দালাল হিসেবে পুলিশ চিহ্নিত করেছে, নরসিংদীর মো. শাহ্জালাল, নুর মোহাম্মদ প্রকাশ ইমরান, জিয়াউর রহমান, আবদুর রহমান; নারায়ণগঞ্জের রফিকুল ইসলাম, শহিদ উল্লাহ, আবদুস সাত্তার; চুয়াডাঙ্গার মো. আকিম, মো. কাশেম, আকিল উদ্দিন; সিরাজগঞ্জের সাত্তার মোল্লা, কুড়িগ্রামের মো. সালাম, সাতক্ষীরার আশরাফ মিয়া, বগুড়ার সাহাব উদ্দিন, যশোরের আবুল কালাম, মেহেরপুরের আহাম্মদ উল্লাসহ অন্তত ৩০০ জনকে।

টেকনাফ মানব পাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট হলেও পাচারকারী চক্রের বিস্তৃতি রয়েছে মহেশখালী থেকে একেবারে মালয়েশিয়া পর্যন্ত। মহেশখালীতে পাচারকারী চক্রের প্রধান ‘ঘাঁটি’ হচ্ছে কুতুবজোন ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নে রয়েছে অন্তত অর্ধশত মানব পাচারকারী। উখিয়ার সোনারপাড়া, মনখালীর শামলাপুরসহ আশেপাশের এলাকায় শতাধিক এবং টেকনাফে রয়েছে আরও অর্ধশত পাচারকারী। এসব পাচারকারীদের সমন্বয়ে পৃথকভাবে রয়েছে ২০টিরও বেশি চক্র।

টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান জানান, উপকূলের বেশিরভাগ ঘাটে অন্তত দুই শতাধিক মানবপাচারকারী সক্রিয় রয়েছে। প্রতিরাতে মানবপাচার হয়। আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় একাধিকবার পর্যাপ্ত তথ্যসহ উপস্থাপন করলেও রহস্যজনক কারণে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না বলে তিনি দাবী করেছেন।

অনুসন্ধান ও তদন্তের মাধ্যমে দালালদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম। তিনি বলেন, অনুসন্ধান ও তদন্তে সব তথ্য বের হয়ে আসবে; এরপর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উল্লেখ্য, চলতি বছর সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারের চেষ্টাকালে প্রায় ৩০০ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ডিসি৭১/২২-এমইউনয়ন