বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৫৩ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
চিকিৎসককে মারধর, দ্বিতীয় দিনের মতো কক্সবাজার সদর হাসপাতালে কর্মবিরতি মাদক কারবারির ভবন জব্দ করল দুদক ঢাকাসহ চার বিভাগে অতিভারী বর্ষণ, চট্টগ্রামে ভূমিধসের শঙ্কা ভারতে পালানোর সময় সাবেক এমপি ফজলে করিম চৌধুরী আটক ১০ম গ্রেডে বেতনের দাবীতে কক্সবাজার সার্ভে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের স্মারকলিপি প্রদান উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত দুই কক্সবাজারে চিকিৎসককে মারধর: সরকারিতে সেবা বন্ধ হলেও চালু আছে বেসরকারি হাসপাতালে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কমিটি বাতিল কক্সবাজারের পুলিশ এখন থেকে ইনসাফের সাথে কাজ করবে- পুলিশ সুপার মোঃ রহমতুল্লাহ সরকার পরির্তনের ফলে টেকনাফ এর শাহপরীরদ্বীপে ভূমিদস্যুদের কবল থেকে চিংড়ি ঘের ও চাষাবাদের জমি অপদখল রক্ষা পেতে যৌথ বাহিনী বরাবরে আবেদন করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা

দুর্নীতিতে বেপরোয়া চেয়ারম্যান রাশেদ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

কক্সবাজারের নবগঠিত উপজেলা ঈদগাঁও’র ৫নং জালালাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ইমরুল হাসান রাশেদের দুর্নীতি যেনো রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে। চেয়ারম্যানের পদটি ব্যবহার করে ঘাটে ঘাটে দুর্নীতি করে যাচ্ছেন তিনি।

এলজিএসপি, মসজিদ মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ সরকারি সমস্ত অর্থ আত্মসাৎ করে নিজের মতো করে ব্যবহার এবং কুক্ষিগত করে রাখার গুরুত্বর অভিযোগ এনেছে তারই পরিষদের অপরাপর এমইউপি সদস্যরা।

জন্মসনদ, চেয়ারম্যান সনদ ও যাবতীয় প্রত্যয়ন পত্র পেতে দিতে হচ্ছে মোটা অংকের টাকা। ফলে পুরো পরিষদই যেনো দুর্নীতির আঁতুড়ঘরে নিমজ্জিত হয়েছে। চলছে দুর্নীতির ভরা যৌবন। এভাবে করে প্রতিটি নাগরিকের ঘরে ঘরে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে চেয়ারম্যান রাশেদের দুর্নীতির অভিশাপ।

লোকাল গভর্ন্যান্স সাপোর্ট প্রজেক্ট (এলজিএসপি) জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে কার্যকর ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণে সরকারের একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। অনুন্নত এলাকায় উপস্থাপন করা তিনটি প্রকল্পে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত যে প্রকল্প সেখানেই ব্যয় হয় এলজিএসপির টাকা। কিন্তু তথ্য গোপন করে নিজের বাড়িতে যাতায়াতের পথ তৈরিতে এলজিএসপি-৩ এর ৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন চেয়ারম্যান ইমরুল হাসান রাশেদ।

শুধু এটি নয়, মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ করা প্রায় ৮ লাখ টাকা মূল্যের সরকারি সৌর প্যানেল বসানো হয়েছে চেয়ারম্যানের বাড়ির ছাদে। ইউনিয়ন পরিষদ আইন ২০০৯ এর ধারা ৩৪(৪) (ঘ) অনুযায়ী অসদাচারণ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে চেয়ারম্যান পরিষদের নানা ভাবে আয়ের কোটি টাকা ভূঁয়া প্রকল্প দেখিয়ে অনৈতিক ভাবে আত্মসাৎ করেছেন। পরিষদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম-দুর্নীতির এসব অভিযোগের প্রমাণসহ প্রধানমন্ত্রী, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী, একই মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও ৪নং ওয়ার্ডের মেম্বার ওসমান সরওয়ার ডিপো।

অভিযোগে দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতা-স্বজনপ্রীতি ও নানান অনিয়মের মাধ্যমে চেয়ারম্যান রাশেদ অবৈধ অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের এলজিএসপি-৩’র ১নং প্রকল্প ফরাজীপাড়া সড়কের দক্ষিণ লরাবাগ এলাকায় মাষ্টার ইদ্রিচের বাড়ী পর্যন্ত পশ্চিম পার্শ্বে বক্স কালভার্ট ও গাইড ওয়ালসহ রাস্তা প্রসস্থকরণ এবং সিসি ঢালাই দ্বারা উন্নয়ন। চেয়ারম্যানের নিজ বাড়ীর এ প্রবেশ পথ তৈরিতে ব্যয় হয় ৫ লাখ টাকা। ২টি যৌথ প্রকল্পে রাস্তা প্রসস্থকরণ ও সিসি ঢালাই দিয়ে নিজের যাতায়াত পথটির স্থায়ী উন্নয়ন হলেও সরকারের অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের টাকার অপব্যবহার করেছেন তিনি। প্রকল্প শেষে নামফলক দেয়ার বিধান থাকলেও অপকর্ম লুকাতে প্রকল্পের নাম ফলকের স্থান করেও বসানো হয়নি প্রকল্প নাম। এছাড়ও ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে এডিপির ১নম্বর প্রকল্প ঈদগাঁও বাজারের কামাল সওদাগরের দোকান হতে কালিবাড়ী রাস্তার মাথা পর্যন্ত ব্রীক সলিন করার কথা বলে ২ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়। কিন্তু এটি স্থানীয় দোকান মালিকরা নিজেদের চাঁদায় ৩৫ হাজার টাকা তুলে মেরামত করেন। সেই প্রকল্পে চেয়ারম্যান সভাপতি ও ফরাজীপাড়ার রাশেদ নামে একজনকে সচিব করে বরাদ্দে ২লাখ টাকা তুলে নেন।

এডিপি খাতের দক্ষিণ লরাবাগ এডভোকেট হুমায়ুনের বাড়ী হতে সেলিম মেম্বারের বাড়ী পর্যন্ত আরসিসি পাইপ স্থাপন প্রকল্প নামে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৬৬৮টাকা বরাদ্দ কাগজে থাকলেও চেয়ারম্যান সভাপতিত্বে এ প্রকল্পের বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। একই অর্থ বছরের উপজেলা উন্নয়ন সহায়ক তহবিলের জালালাবাদ ইউপি ভবনের পিছন ও পশ্চিম পার্শ্বে আরসিসি পোষ্টসহ ব্রীক ওয়াল দ্বারা প্রটেক্টটিভ ওয়ার্ক (অংশ-১)’র জন্য দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেখানো হলেও কাজটি পরিষদের নতুন ভবন নির্মাণকারী ঠিকাদারই করে দেন। কিন্তু প্রকল্প দেখিয়ে টাকাটি হাতিয়ে নেন চেয়ারম্যান।

নিয়মানুসারে ৫নং ওয়ার্ডের কাজে সেই ওয়ার্ডের মেম্বার ও মহিলা মেম্বারকে প্রকল্প কমিটিতে রেখে বাস্তবায়নের কথা হলেও চেয়ারম্যান ক্ষমতার অপব্যবহার করে ৫নং ওয়ার্ডের দুটি প্রকল্প দেখিয়ে একটিতে ৩ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার সেলিমকে (চেয়ারম্যানের আপন চাচাত ভাই) সভাপতি অপরটিতে চেয়ারম্যান নিজে সভাপতি হয়ে ভ্যাট-টেক্স বাদ দিয়ে ১ লাখ ৮২ হাজার টাকা করে দু’প্রকল্পে ৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা উত্তোলন করেন।

এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত হতদরিদ্র পরিবারের জন্য বরাদ্দ ১৮টি সেমিপাকা ও টিনেরঘর শুধুমাত্র দুই ওয়ার্ডে তার পছন্দের মানুষকে দিয়েছেন চেয়ারম্যান। এরমধ্যে তার আপন বড় ভাই স্বচ্ছল এস.এম তহিদুল ইসলামকে ৩লাখ টাকা দামের একটি ঘর বরাদ্দ দেন। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে ঘর বণ্টন করায় সাধারণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হয়েছেন। ইউনিয়নের শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ ৮লাখ টাকা দামের সরকারি বড় সৌর-প্যানেল জনস্বার্থে ব্যবহার না করে চেয়ারম্যান নিজের বাড়ির ছাদে বসান, যা ইউপি আইন পরিপন্থী।

অভিযোগে আরো উল্লেখ করা হয়, ঈদগাঁও বাজার থেকে জালালাবাদ ফরাজীপাড়া পর্যন্ত খালপাড়ের বেঁড়িবাধের দুইটি জায়গা ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে দ্রুত মেরামতের জন্য প্রকল্প নেয়া হয়। ২০১৮-২০১৯ এলজিএসপি-৩ প্রকল্পে মনজুর মৌলভীর দোকানের সামনের বেঁড়িবাধ সংস্কারে বরাদ্দ দেয়া হয় ৩ লাখ টাকা। এরআগে একই এলাকায় ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে মেরামত না করে খেয়ে ফেলেন চেয়ারম্যান। পরবর্তী ৩ লাখ টাকার প্রকল্পও যথাসময়ে সংস্কার না করায় বর্ষায় বেঁড়িবাধটি ভেঙ্গে রাস্তার তিন অংশ, ৫টি দোকান, ৪০টির মত ঘর ভেঙ্গে শতাধিক পরিবারের ক্ষয়-ক্ষতি হয়।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, জেলা পরিষদ ও অন্যান্য সরকারি সংস্থা কর্তৃক করা প্রকল্প তথ্য গোপন করে সুকৌশলে ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন প্রকল্প দেখিয়ে কতিপয় এমইউপি ও দুর্নীতিবাজ সচিবের সহযোগিতায় অনিয়মে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। ভিজিএফ চাউল-গম জনপ্রতি ১২-১০কেজি করে দেয়ার কথা থাকলেও চেয়ারম্যান দিয়েছেন ৫-৬ কেজি। কোভিড-১৯ মহামারিতে ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতায় চার দফায় বরাদ্দ ১২ টন ৫২০ কেজি চাউল এক হাজার ২৫২ জনের জন্য ১০ কেজি করে দেয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ১১জন এমইউপির ওয়ার্ড ভিত্তিক ৪৮ জন করে ৫২৮ জনের তালিকা জমা নিয়ে বাকী ৭২৪ জনের তালিকা চেয়ারম্যান নিজেই করে বরাদ্দ দেন।

অভিযোগকারী ওসমান সরওয়ার ডিপো বলেন, ছাত্রলীগের জেলা সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন চেয়ারম্যান প্রার্থী হওয়ায় তারুণ্য বিবেচনা করে ইমরুলকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু দায়িত্বপাবার পরই টাকার পাহাড় গড়তে মরিয়া হয়ে অনিয়মের আশ্রয় নেন চেয়ারম্যান। ইউপি আইন না মেনে নৈশ প্রহরী নিয়োগ করে নিজে টাকা হাতিয়ে নেন। নতুন ভবন বুঝিয়ে দেয়ার পরও দু’বছর মাসিক ভাড়ায় ঝুপড়ি ঘরে পরিষদের কার্যক্রম চালান।

তিনি আরো বলেন, টিআর-কাবিখা প্রকল্পের কাজ না করে সম্পূর্ণ টাকা আত্মসাৎ, কর্মসৃজন প্রকল্পের ব্যাপক অনিয়ম, জেলে ভাতা মনগড়া তালিকা, প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার চেয়ারম্যান পরিবারে বিতরণ, পরিষদের মূল আয় ওয়ারিশ সনদের বিপরীতে পাওয়া ২০ লাখ ৩০ হাজার টাকা ও ভূমিহীন সনদের ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা, প্রত্যায়ন ও সনদে আয় ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিষদের আয় ফান্ডে জমা না করে নিজে আত্মসাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ব্যাপক অনিয়ম, ইউপির দু’সদস্য ও ইউপি সচিবের সহায়তায় ১২টি প্রকল্প (প্রায় ২৪ লাখ টাকা) কাজ না করে টাকা উত্তোলনের পর আত্মসাৎ করেন। তাছাড়া জেলা পরিষদ ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক করা প্রকল্পকে ইউনিয়ন পরিষদের প্রকল্প দেখিয়ে (১০টির মত) প্রকল্পের প্রায় ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন চেয়ারম্যান। এছাড়াও পরিষদের মালিকানাধীন সড়কের ৩৫০টি বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রাতের আঁধারে কেটে বিক্রি করা হয়েছে। যার স্পষ্ট প্রমাণপত্র উপস্থাপন করা হয়েছে অভিযোগে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিষদ সংশ্লিষ্ট অনেকে বলেন, পরিষদের ২০১৬ হতে ২০২১ সময়ের আয়-ব্যয় হিসাব দেখলে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ মিলবে। ছাত্রলীগ নেতা থাকাকালে দৃশ্যমান কিছু না থাকলেও চেয়ারম্যান হবার পর ইমরুল রাশেদ এখন কোটিপতি। গড়েছেন ৬০ লাখ টাকা দামের আলিশান বাড়ী, ২০ লাখ টাকা দামের প্রাইভেট কার, ১৮ লাখ টাকা দামের নোহা, কোটি টাকা মূল্যের সেইফ ইসলামিয়া মার্কেটের ৯টি দোকান, ৪০ লাখ টাকায় কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে ফ্ল্যাট বুকিং, ঢাকা ব্যাংকে ৫০ লাখ টাকার এফডিআরসহ বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে একাউন্ট রয়েছে।

এসব অভিযোগ অস্বীকার করে চেয়ারম্যান ইমরুল হাসান রাশেদ মুঠোফোনে বলেন, আমার বিরুদ্ধে উত্তাপন করা অভিযোগের একটিও প্রমাণ করতে পারলে চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করবো। সামনের দিনে আর কখনো নির্বাচনে অংশ নেবো না।

অভিযোগের কপি পেয়েছেন উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার বিভাগের কক্সবাজারস্থ উপ-পরিচালক শ্রাবস্তী রায় বলেন, চেয়ারম্যান রাশেদের বিরুদ্ধে অনিয়মের কয়েক ধরণের অভিযোগ হয়েছে বিভিন্ন বিভাগে। অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন ও ব্যবস্থা নিতে চিঠি এসেছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা তদন্ত করছেন।