রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৫৭ পূর্বাহ্ন
কক্সবাজার ৭১ ডেস্ক ॥
পর্যটন কেন্দ্রগুলো বেশি নিরাপদ থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশে তার উল্টো। ধর্ষণ ছাড়াও পর্যটন কেন্দ্রগুলো মাদকসহ নানা অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আর অপরাধীদের সাথে এক শ্রেণির পুলিশের সমঝোতা থাকায় তারা বলতে গেলে বেপরোয়া।
কক্সবাজার ছাড়াও বাংলাদেশের আরো একটি সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায়ও এর আগে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে রাঙামাটিতেও। ২০১৯ সালে কক্সবাজারে এক অস্ট্রেলীয় নারী ধর্ষণের শিকার হন। এরপর বিষয়টি আলোচনায় এলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। তার আগে ২০০৫ সালে আরো এক বিদেশি নারী ধর্ষণের শিকার হন। স্থানীয় সূত্র জানায়, ওই দুইটি ঘটনায় আসামিরা গ্রেপ্তার হলেও পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে যান।
এদিকে সর্বশেষ কক্সবজারের সমুদ্র সৈকত থেকে তুলে নিয়ে হোটেলে সংঘবন্ধ ধর্ষণ মামলার মূল আসামিরা এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। মোট সাত জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে ওই নারী পুলিশের সহায়তা চেয়েও পাননি। পরে র্যাব গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। কিন্তু পর্যটন কেন্দ্রের মূল দায়িত্বে থাকা টুরিস্ট পুলিশ এখনো নির্বিকার।
গত ১৩ জানুয়ারি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন একটি হোটেলে এক তরুণী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। তিনি বন্ধুদের সাথে সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে গিয়েছিলেন।
এর আগে ২০২০ সালের আগস্টে এক স্কুল ছাত্রী কুয়াকাটার আরেকটি হোটেলে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। তিনিও সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে গিয়েছিলেন।
২০১৯ সালের মার্চে বান্দরবানে মেঘলা পর্যটন মোটেলে ঘুরতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হন এক নারী? ওই ঘটনার আসামিরা সবাই গ্রেপ্তার হয়েছেন।
এর বাইরেও বিনোদন ও পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে আরো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। গত ১ এপ্রিল বরগুনার তালতলী এলাকায় ইকোপার্কে ঘুরতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক নারী। গত ২ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের হাওরে স্বামীসহ ঘুরতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক নববধূ। দুর্বৃত্তরা স্বামীকে বেঁধে রেখে ধর্ষণের ঘটনা মোবাইল ফোনে ভিডিও করে। প্রকাশ করলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করার হুমকি দেয়া হয়। গত ৬ অক্টোবর সীতাকুণ্ডের পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক মাদ্রাসা ছাত্রী। এখানেও ধর্ষকরা ভিডিও ধারণ করে। এরকম আরো অনেক ঘটনা আছে।
পর্যটন কেন্দ্র ও পর্যটকদের নিরাপত্তার প্রধান দায়িত্ব বাংলাদেশ টুরিস্ট পুলিশের। তাদের এক হাজার ৩০০ সদস্য আছে। দেশের মোট ১০৪টি পর্যটন কেন্দ্রে নিরপত্তার দায়িত্বে আছেন তারা। তাসারাদেশে স্টেশন আছে ৭১টি। টুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মাহবুব হাকিম বলেন, ‘‘কক্সবাজারের ঘটনায় টুরিস্ট পুলিশ তৎপর না হলেও পুলিশই তো তৎপর হয়েছে। র্যাব বা থানা পুলিশও তো পুলিশ।’
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের হ্যালো টুরিস্ট নামে একটি অ্যাপ আছে, ফেসবুক পেজ আছে। সেখানে অভিযোগ জনাতে পারেন টুরিস্টরা। স্থানীয় টুরিস্ট পুলিশ অফিসের ফোন নাম্বারও দেয়া থাকে। আমরা অনেক সাড়া পাই। আর ৯৯৯ তো আছেই। সেখানে অভিযোগ করলেও আমরা সাড়া দেই।” তিনি আরো জানান, পর্যটকের জীবন ও সম্পত্তির কোনো ক্ষতি হলে তা দেখা তাদের দায়িত্ব।
বাংলাদেশে নারীরা পর্যটন কেন্দ্র, পার্ক বা বিনোদন কেন্দ্র কোথাও নিরপদ নন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে এক হাজার ২৪৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ২৮৬ জন। ৪৬ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন নয়জন।
গত বছর ১২ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৬২৭ জন। ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ৩২৭ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৩ জনকে। আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১৪ জন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘‘কক্সবাজারের মতো এলাকা যেখানে পুলিশ, শত শত মানুষ তার মধ্যেই যদি নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয় তাহলে পুরো বাংলাদেশের পরিস্থিতি কী তা সহজেই বুঝা যায়। দুই-একটি ঘটনা যা সংবাদমাধ্যমে আসে তা নিয়ে আমরা কথা বলি। বাকি ঘটনাগুলো চাপা পড়ে যায়। প্রভাবশালীরা পার পেয়ে যায়। কক্সবাজারে যারা জড়িত তারাও প্রভাবশালী বলে জেনেছি। তাদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হয় তাহলে এই ঘটনা বার বার ঘটতেই থাকবে।”
এই ঘটনাকে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করেন প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব তৌফিক রহমান। তিনি বলেন, ‘‘আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দায় দায়িত্ব আছে। কিন্তু পর্যটনের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে কমিউনিটি সাপোর্ট আমরা পাচ্ছি না। কক্সবাজারের ঘটনায়ও তাই দেখলাম। এর আগে বিজয় দিবসের বন্ধে হাজার হাজার পর্যটক যান কক্সবাজারে, তখন তারা সব কিছুর দাম অবিশ্বাস্যভাবে বাড়িয়ে দেন। এটার যদি অবসান না হয় তাহলে বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে না।”
তিনি জানান, ২০০৫ সালেও একবার ইরানি এক নারী কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।