শনিবার, ১৭ মে ২০২৫, ০৮:৩০ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
সুগন্ধায় শফিক ,সোহেল, রাসেল ও ফরিদ সিন্ডিকেটের চাঁদাবাজির নতুন কৌশল রাজেশ আছে রাজার হালে দ্রুত সিদ্ধান্ত না আসলে সারা দেশ থেকে ঢাকা মার্চ : নাহিদ রামুতে সড়ক দূর্ঘটনায় মাদ্রাসা শিক্ষক নিহত রামুর কাউয়ারখোপে নদী ভাঙ্গন পরিদর্শনে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড উখিয়ায় অনলাইন জুয়ার ভয়াল ছোবল, বেড়ে চলছে চোরের উপদ্রব প্রশাসনের নজরদারী জরুরী কক্সবাজার বিআরটিএ অফিসে দুদকের হানা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া দেশটির সেনা ও বিজেপি সদস্যসহ ৪০ জন মিয়ানমারের নাগরিককে স্বদেশে ফেরত পাঠিয়েছে বাংলাদেশ শনাক্তদের ধরতে তৎপর পুলিশে, যুবলীগের ঝটিকা মিছিল শহরে তোলপাড় প্রশাসনের চেয়েও শক্তিশালী দখলবাজ!

সাংবাদিকপুত্র আবদুল্লাহর হাসপাতালে ‘মৃত্যুযন্ত্রণা’র ৩ মাস

>> মানবিক চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টায় স্বাভাবিক জীবনে

>> তিন বছরের ছোট্ট শরীরে তিনবার অস্ত্রোপচার

>> বুকে জমে গিয়েছিল রক্ত ও বাতাস

>> টমটম দূর্ঘটনায় পুরো পরিবারের যন্ত্রণাময় জীবন

রামু প্রতিনিধি:
২০২৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিকেল বেলা। ৩ বছরের ছোট্ট শিশু মুহাম্মদ আবদুল্লাহ বাড়ির পাশের গ্রামীণ রাস্তায় খেলতে বের হয়েছিল। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, একটি ব্যাটারিচালিত টমটম গাড়ি ছোট্ট সেই শিশুর বুকের উপর উঠে যায়। টমটমের চাকা শিশুটির বুকে চেপে বসে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় অনেক দূর। দূর্ঘটনার পর শরীরের কোথাও আঘাত দেখা না গেলেও শুরু হয় শ^াসকষ্ট। দেখা দেয় দমবন্ধ অবস্থা। দ্রুত তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রামু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখান থেকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে। মধ্যরাত পর্যন্ত অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে রাতেই তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ভোর রাতে আদরের ছেলে ‘পুতু’কে নিয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০ম তলায় শিশু সার্জারি বিভাগের ৮৪ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হন সাংবাদিক মুহাম্মদ আবু বকর ছিদ্দিক। মফস্বলের এই সাংবাদিক ছেলেকে পড়ে যান অকুল পাতারে। একদিকে চিকিৎসার খরচের সংকট, অন্যদিকে কক্সবাজার থেকে অনেক দূরে চট্টগ্রাম শহরে আত্মীয়-পরিজন কেউ নেই।

ঠিক ওই সময়ে মানবিক চিকিৎসক হয়ে সামনে এসে দাঁড়ান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের থোরাসিক সার্জারি বিভাগের ডা. মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন ও ডা. জাকির হোসেন ভূঁইয়া এবং হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল তসলিম উদ্দীন। এই তিন মানবিক মানুষের অক্লান্ত চেষ্টা ও টানা ৩ মাসের চিকিৎসায় মুত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে শিশু মুহাম্মদ আবদুল্লাহ।

বুকে রক্ত ও বাতাস জমে যাওয়ায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির দিনই ছোট্ট শিশু আবদুল্লাহর ফুসফুসে অস্ত্রোপচার করা হয়। বুকের ডান পাশে দেয়া হয় আইসিডি টিউব। মুখে অক্সিজেন, প্রস্রাবের রাস্তায় ব্যাগ, খাদ্যের বদলে স্যালাইন আর ইনজেকশন দেয়ার জন্য সুই লাগানো। অসহ্য এক যন্ত্রণা নিয়ে জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি শিশু আবদুল্লাহ।

দরকার ছিল পিআইসিইউ (পেড্রিয়াটিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট)। কিন্তু সেটাও মিললো না। বুকে দেয়া আইসিডি টিউব থেকে রক্ত পানি বের হয়ে যাওয়া কথা। সেখানেও ঘটলো বিপত্তি। রক্ত পানির বদলে আসছিল পৌঁজ। এই অবস্থায় থোরাসিক বিভাগের চিকিৎসকরা আবদুল্লাহকে পাঠালেন লাঞ্চের ডাক্তারের কাছে। অনেকবার দেখানোর পর চিকিৎসকরা জানালেন, টিউব দিয়ে যদি পুঁজ পানি পড়তেই থাকে আবদুল্লাহকে আরও বড় অপারেশন করতে হবে। কিন্তু মেডিকেলের থোরাসিক বিভাগ ও শিশু সার্জারি বিভাগ নতুন করে অপারেশন করাতে গড়িমসি শুরু করেন। কোন ভাবে অপারেশনের সিডিউল দিতে পারছিলেন না। তখনই সাহায্যের হাত বাড়ান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতা লের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন। তার সহযোগিতায় ১২ অক্টোবর আবারও একদফা বড় রকমের অস্ত্রোপচার হয় আবদুল্লাহর শরীরে। সেদিন আগের টিউব খুলে নিয়ে এবার লাগানো হয় দুইটি আইসিডি টিউব, যার একটিতে সাদা পানি অন্যটিতে পুঁজ পানি বের হতে থাকে।
ইতোমধ্যে শিশু আবদুল্লাহ খাদ্যনালীতে সমস্যা দেখা দেয়। তরল জাতীয় খাবার খেলেই তা সরাসরি টিউবে চলে আসতে থাকে। আবারও অনেক গুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর থোরাসিক সার্জারি বিভাগ সিদ্ধান্ত নেয়, আবারও অস্ত্রোপচার করা হবে শিশু আবদুল্লাহ শরীরে।

কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়েও চিকিৎসকরা শিশুটির কষ্টের কথা ভেবে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসেন। বাবা সাংবাদিক আবু বকর ছিদ্দিককে জানানো হয়, নাকে নল দিয়ে খাবার খাওয়াতে। ২১ দিন মুখে খাবার না খেলে খাদ্যনালীর সমস্যা ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ৬ নভেম্বর শিশু আবদুল্লাহকে রেফার করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ওখানে নেয়া হলে থোরাসিক সার্জারি বিভাগ ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ সার্জন সহকারি অধ্যাপক ডা. মো. সেরাজুস সালেকিন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানান, ‘সব ঠিক আছে’।

আবারও শিশু আবদুল্লাহকে নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু মুখে খাদ্য না দেয়ায় শিশুটির স্বাস্থ্যের অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে। এভাবে প্রায় তিনটি মাস অসুস্থ শিশু সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে কাটিয়ে দেন আবু বকর ছিদ্দিক। একদিকে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, অন্যদিকে উপার্জনের একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে হাসপাতালে আটকে থাকায় পরিবারে দেখা দেয় দুর্দশা।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের থোরাসিক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মুহাম্মদ জাকির হোসেন ভূঁইয়া ও মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন জানান, হাসপাতালে আনার পরপরই যদি ‘ইমার্জেন্সি অপারেশন’ করা না হতো তাহলে শিশুটিকে বাঁচানো যেতো না।

এই দুই চিকিৎসক একটি মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মেডিকেল কলেজের বাইরে জরুরি ভিত্তিতে রোগীকে পার্সোনাল চেম্বারে নিয়ে যেতে হলেও একটিবারও ভিজিট নেননি ডাঃ জাকের হোসেন ভূইয়া। চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালের মানবিক ডাঃ সাজ্জাদ হোসেন

সবসময় মূমূর্ষ রোগী আব্দুল্লাহকে সুচিকিৎসা, সু-পরামর্শ ও সার্বিক সহযোগিতা করে গেছেন। এরা রোগীকে উল্টো আর্থিক সহায়তা ও পুষ্টিকর খাবার কিনে দিয়ে আরও বেশি মানবিকতার নজির স্থাপন করেছেন।

সাংবাদিক আবু বকর ছিদ্দিক বলেন, ডাঃ মুহাম্মদ জাকির হোসেন ভূঁইয়া ও মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেনের আন্তরিক ও মানবিক সহযোগিতা না পেলে হয়তো আমার ছেলেকে বাঁচানো যেতো না। তিনি এই দুই চিকিৎসক ছাড়াও পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের ডা. গোলাম হাবিবুর রহমান, ডা. মাসুম বিল্লাহ, ডা. অন্তর দ্বীপ, ডা. মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, ডা. ইফাত, ডা. রুবাইদাসহ সকল চিকিৎসক, নার্স ও সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।

তিনি জানান, অপারেশনের আগে-পরে পিআইসিইউ’র সহকারি রেজিষ্ট্রার ডা. বিবেক দেব সবসময় আন্তরিক চিকিৎসা দিয়েছেন। তিনি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. আশিকুর রহমান ও রামু উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নোবেল কুমার বড়ুয়ার প্রতিও অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ অন্তবর্তী সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা ড: আ.ফ.ম খালেদ হোসাইন, বাংলাদেশ সাংবাদিক কল‍্যাণ ট্রাষ্টের পরিচালক এম.আব্দুল্লাহ। শিশু আবদুল্লাহর চিকিৎসা কর্মযজ্ঞে চিকিৎসকদের পাশাপাশি যে মানুষটি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রেখেছিলেন তিনি হলেন পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) সাখাওয়াত হোসাইন। তাঁর ফোন কল না এলে হয়তো হাসপাতালের কঠিন চিকিৎসা ব্যবস্থাটা অতোটা সহজ হতো না।

দৈনিক দিনকালের ও দৈনিক সৈকতের রামু উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত মুহাম্মদ আবু বকর ছিদ্দিক বলেন, মহান আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া, আলহামদুলিল্লাহ। সবার দোয়া ও মানবিক চিকিৎসকদের উছিলায় আমার ‘পুতু’কে মৃত্যু হাত থেকে ফিরিয়ে এনেছেন মহান আল্লাহ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, জানা অজানা, চেনা অচেনা অসংখ্য মানুষের দোয়া, সহযোগিতায় অসহ্য যন্ত্রণাময় একটি সময় থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছে আমার ছোট্ট ছেলে আবদুল্লাহ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *