দৈনিক কক্সবাজার একাত্তর ডেস্ক:- দেশের শিক্ষা নিয়ে খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। কিছুদিন পরপর খোলনলচে বদলে ফেলার কারণে শিক্ষা খাতে একধরনের অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। তাই আগে ঠিক করে নিতে হবে কোন নীতি, কোন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। এ ছাড়া ‘উপসর্গ’ ধরে ব্যবস্থা না নিয়ে শিক্ষার সামগ্রিক বিষয়গুলো চিন্তা করে এগোতে হবে।
আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস উপলক্ষে আজ বুধবার বিকেলে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযান আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা উঠে আসে। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এই মতবিনিময় সভায় শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা অংশ নিয়ে নানা মতামত দেন। মতবিনিময় সভায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলীও বক্তব্য দেন।
আলোচনা সভায় নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে সেগুলো দূর করা, শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে উপযুক্ত করে গড়ে তোলাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন বক্তারা।
দেশের সব বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং এমএলএসএস নিয়োগও সরকারিভাবে (বর্তমানে সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ হয় এনটিআরসির অধীনে পরীক্ষার মাধ্যমে) করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি অনুরোধ জানান মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন। তিনি বলেন, ‘এটা করা না গেলে আমরা মানসম্মত শিক্ষক পাব না। এটা করতেই হবে।’
এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন সিমিন হোসেন। তিনি বলেন, যাঁরা এমপিওভুক্ত হয়ে মাসে বেতন পাচ্ছেন (শতভাগ মূল বেতন ও কিছু ভাতা), সরকার চাইলে আরেকটু টাকা খরচ করে সরকারীকরণ করে ফেলতে পারে। তিনি মনে করেন, এটা করা উচিত। তাহলে এখানে দুর্নীতি অনেক কমে যাবে এবং মানসম্মত শিক্ষার দিকে যাওয়া যাবে।
এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে মৌখিক পরীক্ষার (ভাইভা) নম্বর আরও কমানোর কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন। এই প্রস্তাবের পক্ষে তাঁর যুক্তি, এটা করা হলে মৌখিক পরীক্ষায় নম্বর বেশি দেওয়ার জন্য সুপারিশ আসবে না। কারণ ওই নম্বর নিয়ামক হয়ে দাঁড়াবে না।
উপযোগিতা দেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভবন করার ওপর জোর দেন সিমিন হোসেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে ভবন তৈরি হচ্ছে (শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে)। একটি প্রকল্পের অধীনে ভবন তৈরি হচ্ছে চারতলা। কিন্তু সেখানে শিক্ষার্থী ১১০ জন। চারতলা ভবনটির উপযোগিতা কী? তাঁর মতে, শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেখে ভবন করা উচিত। তিনি দেখতে পেয়েছেন অনেক স্কুল-মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বেশি, কিন্তু ভবন নেই। অথবা ভবন অনেক আগে করা ছিল, যেটিতে ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ সম্ভব নয়।
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠাগার ভালোভাবে চালু করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন।
যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী কম, সেখানে মূল্যায়ন (শিখনকালীন মূল্যায়ন) কাজ করা গেলেও দেড় শ শিক্ষার্থী থাকা স্কুলে সেভাবে করা যায় না বলে মনে করেন নতুন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী। সে ক্ষেত্রে পরীক্ষাব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, শিক্ষা নিয়ে খুব বেশি পরীক্ষা- নিরীক্ষা করা হচ্ছে। ঠিক করে নিতে হবে কোন নীতি, কোন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। চলার পথে কিছু পরিবর্তন, পরিমার্জন হবেই। কিন্তু কিছুদিন পরপর খোলনলচে বদলে ফেলার ফলে শিক্ষা খাতে একটি অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। যেমন জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ পঞ্চম শ্রেণিতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা ছিল না, কিন্তু হঠাৎ করে এটি শুরু করা হলো (পরে বাদ দেওয়া হয়)। এটি বন্ধ করার ক্ষেত্রে তাঁর সামান্য ভূমিকা ছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা হলো বাস্তবায়ন। নীতি আছে, কর্মসংস্থান আছে, অনেক জায়গায় বরাদ্দেরও সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা হলো বাস্তবায়নে। তাই কার্যকরভাবে সময়মতো বাস্তবায়ন জরুরি।
মতবিনিময় সভা সঞ্চালনা করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি মনে করেন, নতুন শিক্ষাক্রমের দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা করা যেতেই পারে। ভুল থাকতেই পারে। কারণ, এটি চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু এখন এটি নিয়ে নানাভাবে পানি ঘোলা করা হচ্ছে। ভুল তথ্য দিয়ে বিরোধিতা করা হচ্ছে, যা ঠিক নয়।
যাঁরা কোচিং-বাণিজ্যের ধারক ও বাহক এবং যাঁরা চান না শিক্ষার্থীরা একটি অগ্রসরমুখী শিক্ষাক্রমে যাক, তাঁরাই এই বিরোধিতা করছেন বলে মনে করেন রাশেদা কে চৌধূরী। বিরোধিতাকারীদের উদ্দেশে তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে মতামতের জন্য যখন দুই মাস খসড়াটি ওয়েবসাইটে দেওয়া ছিল, তখন কেন মতামত-বক্তব্য দেননি?
শিক্ষার সবগুলো বিষয় সামগ্রিকভাবে চিন্তা করে এগোনোর পরামর্শ দেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনজুর আহমেদ। তিনি জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এর আলোকে উপযুক্ত লোক দিয়ে স্থায়ী শিক্ষা কমিশন করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
মতবিনিময় সভায় আলোচনার বিষয়বস্তুর প্রসঙ্গ টেনে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এখানে যা আলোচনা হয়েছে, সেগুলোকে মানসম্মতভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য টাকা দরকার। অগ্রাধিকার ঠিক করে এই কাজটি করার পরামর্শ দেন তিনি।
মতবিনিময় সভায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে নিজেদের সমস্যা ও চাওয়া-পাওয়ার কথা তুলে ধরেন। বেশ কয়েকজন শিক্ষকও নতুন শিক্ষাক্রমসহ শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন।
মতবিনিময় সভার শুরুতে গণসাক্ষরতা অভিযানের পক্ষ থেকে নানা সুপারিশ তুলে ধরেন সংস্থাটির কর্মকর্তা সামছুন নাহার। তিনি নতুন শিক্ষাক্রমের সঠিক বাস্তবায়নে জনমত গঠন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও সহজে বোধগম্য হয়, এমন মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রণয়ন করাসহ বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন।
Leave a Reply